search the site
সীতাকুন্ড : ১৮০ জাহাজভাঙা কারখানার মধ্যে ১৫৬টিই বন্ধ

একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। ইতোমধ্যে উপজেলার ২০ কিলোমিটার জুড়ে থাকা ১৮০ শিপইয়ার্ডের বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্পটি পুরোপুরি বন্ধ হলে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বেকার হয়ে যাচ্ছে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত দুই লাখের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ব ব্যাংকের নানা চাপ, স্ক্র্যাপ জাহাজের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট, এলসি খুলতে ব্যাংকের কঠিন শর্ত, বিদেশি স্ক্র্যাপ জাহাজ বিক্রিতে অনীহাসহ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে এ শিল্পে দুরবস্থা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রি-সাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) সূত্র জানায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বদৌলতে জাহাজভাঙা শিল্প পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যে সব যাত্রীবাহী বা পণ্যবাহী জাহাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় মালিকরা সেগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিক্রি করে দেয়। বিক্রির পর জাহাজ কাটার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে। তারই ধারাবাহিকতায় জাহাজভাঙা শিল্পকে ঘিরে করে সীতাকুন্ড উপকূলজুড়ে গড়ে উঠে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড।

এ উপজেলায় এক সময় ১৮০টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড ছিল। ২০২১ সালে ৩০টি বন্ধ হয়ে যায়। বাকি ১৫০টি কারখানার মধ্যে ১০৫টিকে পরিবেশবান্ধব (গ্রিন) করার জন্য অনুমোদন দিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত গ্রিন সনদ পেয়েছে মাত্র সাতটি কারখানা। আরও ১৭টি কারখানা গ্রিন করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে এ অঞ্চলে সচল রয়েছে ২৪টি ইয়ার্ড। নানা সংকটে বাকি কারখানাগুলো ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।
কারখানা সংশ্লিষ্টরা জানায়, বর্তমানে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল ৫০ শতাংশ যোগানদাতা এ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। কারখানাগুলো শিপ ব্রেকিং লৌহজাত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল এমন পরিস্থিতিতে সম্ভাবনাময় ইস্পাত খাত পড়েছে সংকটে।
শিপ ইয়ার্ডের মালিকরা জানান, বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থানে থাকা সম্ভাবনাময় জাহাজভাঙা শিল্পটি পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগে দেশি-বিদেশি চক্র। তারা ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থাও পরিবেশের দোহাই দিয়ে বিদেশিদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করেছে।
তারা জানান, ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাহাজভাঙা শিল্প প্রথম স্থানে ছিল। এ শিল্প থেকে ১২০০ থেকে ১৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব অর্জিত হয়েছে। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে র্যাংঙ্কিং কমে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এখন বাংলাদেশের নামই নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মালিক জানান, এ শিল্পের সঙ্গে জর্জরিত অধিকাংশ শিপ ইয়ার্ড ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হয়ে দেউলিয়া। অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন। কারণ জাহাজ আমদানির জন্য এলসি করতে ব্যাংকের কঠিন শর্ত। নানা জটিলতায় ব্যবসায়ীরা জাহাজ আমদানি করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে ছোট ব্যবসায়ীরা ঝরে পড়েছেন। তারা ইয়ার্ডগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, জাহাজভাঙা শিল্পকে ঘিরে এখানকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। একটি জাহাজ থেকে হাজারো পণ্য পাওয়া যায়। ইস্পাত খাতের কাঁচামাল থেকে শুরু করে সুঁই সবই মেলে এ খাতে। শিল্পের কাঁচামাল ও বাণিজ্যিক পণ্য ঘিরে এখানে অসংখ্য দোকান ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। রপ্তানিও হচ্ছে জাহাজভাঙা শিল্পের নানা পণ্য।
প্রতি বছর সীতাকুন্ডে ২০০ থেকে ২৫০ জাহাজভাঙা হয়। এ শিল্প থেকে প্রায় ৩০ লাখ টন স্টিল রিসাইক্লিং করা হয়। দেশের ৪৫০ স্টিল রি-রোলিং মিলের মধ্যে ৮০ ভাগই ছোট আকারের এবং তাদের কাঁচামালের জন্য শিল্পের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আগের মত কর্মচাঞ্চল্য নেই বিভিন্ন শিপ ইয়ার্ডে। বেশিরভাগ ইয়ার্ডে জাহাজ নেই। কয়েকটি ইয়ার্ডে জাহাজভাঙার কাজ করছেন শ্রমিকরা। অনেকে গাড়ি নিয়ে যন্ত্রাংশ কিনতে এসেছেন।
এদিকে সিংহভাগ ইয়ার্ডে কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও উপজেলার বোয়ালিয়া নামক আরও একটি মৌজায় জাহাজভাঙা কারখানার জন্য ২০০ একর জমি বরাদ্দ চেয়েছেন কয়েকজন ব্যক্তি। ১০ বছর আগে এ আবেদন করা হলেও সম্প্রতি জেলা প্রশাসন থেকে আবেদনটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
তবে নতুন করে জাহাজভাঙা অঞ্চল বাড়ানো হলে পরিবেশগত দূষণের পাশাপাশি বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের আকিলপুর এলাকায় গড়ে ওঠা সমুদ্র সৈকত নষ্ট হবে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

সমুদ্র সৈকত এলাকার ব্যবসায়ী মো. আরমান বলেন, ‘সৈকতে প্রতিদিন শত শত মানুষ ঘুরতে আসেন। এখানে নতুন করে শিপ ইয়ার্ড গড়ে উঠলে এ সৈকত আর থাকবে না। আমরা চাই এখানে আর ইয়ার্ড গড়ে না উঠুক।’
এ ছাড়া জাহাজভাঙা কারখানা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) শুরু থেকে নতুন জাহাজভাঙা অঞ্চলের বিরোধিতা করে আসছে। তাদের ভাষ্য, এতো ইয়ার্ড ও নতুন অঞ্চলের প্রয়োজন নেই। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা সরকারি সহযোগিতায় অন্য কোনো ব্যক্তি নতুন করে চালুর উদ্যোগ নিতে পারেন।
একটি সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর শিল্প মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন দিয়ে জাহাজভাঙার জন্য সীতাকুন্ড উপকূলের সাতটি মৌজাকে নির্ধারণ করে দেয়। তাতে বলা হয়, সীতাকুন্ড উপজেলার উত্তর ছলিমপুর, ভাটিয়ারি, জাহানাবাদ, শীতলপুর, দক্ষিণ সোনাইছড়ি, মধ্য সোনাইছড়ি ও উত্তর সোনাইছড়ি এ সাত মৌজায় জাহাজভাঙা কাজের জন্য ইজারা দেওয়া খাসজমি অন্তর্ভুক্ত করে পরিবেশসম্মত জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চল ঘোষণা করা হয়।
বোয়ালিয়া মৌজাকে জাহাজভাঙা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেন মাদার স্টিল নামের একটি জাহাজ ভাঙা কারখানার মালিক আবুল কাশেমসহ কয়েকজন ব্যক্তি। মাদার স্টিল ছাড়াও কাশেমের আরও তিনটি কারখানা রয়েছে।
জাহাজ ভাঙা শিল্প ব্যবসায়ী শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের একমাত্র জাহাজভাঙা শিল্প প্রতিনিয়ত দেশিয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। অথচ এ শিল্প আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ ও পরিবেশসম্মত। সাতটি শিপ ইয়ার্ড ইতোমধ্যে গ্রিন ইয়ার্ড হিসেবে সনদ লাভ করেছে। তারপরও এ শিল্পকে নিয়ে নানা অপবাদ ও মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে। যার কারণে পুরোনো জাহাজ আমদানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আমরা এ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অবসান চাই।’
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রি-সাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সাবেক কার্যকরী সদস্য ও মাদার স্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাস্টার আবুল কাশেম বলেন, ‘অধিকাংশ শিপ ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত এক লাখ লোক বেকার হয়ে পড়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বর্তমানে মাত্র সাতটি শিপ ইয়ার্ডকে গ্রিন শিপ ইয়ার্ডে হিসাবে ঘোষণা দেওয়া। প্রতিটি গ্রিন শিপইয়ার্ড করতে ১০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। সরকারিভাবে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সুবিধা দিলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারবে।’
নতুন আবেদনের বিষয়ে আবুল কাশেম বলেন, ‘আমরা ১০ বছর আগে মৌজা বাড়ানোর আবেদন করেছিলাম। বন্ধ হয়ে যাওয়া ইয়ার্ডে কারখানা চালু করতে ব্যাংক ঋণসহ নানা ঝামেলা হবে। ওই এলাকায় ইয়ার্ড হলে ভাঙা বেড়িবাঁধ রক্ষা হবে। আমার লাভ নয়, এতে দেশের লাভ হবে। সবাই মনে করছে আমার আগ্রহ বেশি। অথচ জেলা প্রশাসন যে পরিমাণ জায়গার সুপারিশ করেছে বলে শুনেছি, তাতে আমার জায়গা পড়েনি।’
শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ও সি-শোর ইন্টারন্যাশনালের মালিক কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কখনও অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপ, কখনও আন্তর্জাতিক বাজারে লোহার মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিপুল লোকসানের শিকার হয়েছেন মালিকরা। ব্যবসা বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু এলসির বিপরীতে ব্যাংক লোন পরিশোধ বন্ধ ছিল না। আয় বন্ধ কিন্তু ব্যয় চলমান থাকায় লোকসানে পড়েন মালিকরা।’
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত দিক নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসার সমন্বয়কারী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘নতুন করে ইয়ার্ড স্থাপন হোক, এলাকার লোকজন সেটি চায় না। কারণ, এটা বড় একটা দূষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। এলাকার লোকজনের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত নানা সমস্যা দেখা দেয়। এতগুলো ইয়ার্ড বেকার পড়ে রয়েছে, সেখানে নতুন করে কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সাদি উর রহিম জাদিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিপ ইয়ার্ডের জন্য মৌজা নির্দিষ্ট করে দেওয়া রয়েছে। এর বাইরে ইয়ার্ড গড়ে তোলার সুযোগ নেই। নতুন করে মৌজা বাড়ানোর জন্য একটি আবেদন করেছিল। ওখানে প্রায় ২০০ একর নতুন করে জায়গা চেয়েছেন কারখানা মালিকেরা। মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে এ সংক্রান্ত কিছু বিষয় অনুসন্ধানের জন্য দিয়েছিল। আমরা অনুসন্ধান করে আবেদন করা ভূমির জায়গা দেওয়া যাবে না মর্মে মতামত দিয়েছি।’
source : jagonews24.