বিদেশের বন্দরে দুই মাস ধরে আটকা দুই বাংলাদেশি জাহাজ, খাদ্য-পানি সংকটে ৫০ নাবিক

Comments Off on বিদেশের বন্দরে দুই মাস ধরে আটকা দুই বাংলাদেশি জাহাজ, খাদ্য-পানি সংকটে ৫০ নাবিক

পৃথিবীর দুই প্রান্তে প্রায় দুই মাস ধরে আটকে আছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ। এতে তীব্র খাদ্য ও পানি সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন জাহাজ দুটির ৫০ জন বাংলাদেশি নাবিক। 

দুটি জাহাজই দেশের শীর্ষস্থানীয় মেঘনা গ্রুপের মালিকানাধীন। বাংলাদেশি পতাকাবাহী ১০৩টি সমুদ্রগামী জাহাজের মধ্যে ২৫টিই এ গ্রুপের।

এর মধ্যে বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার উসলুগা বন্দরের কাছে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে আটকে থাকা জাহাজের নাম মেঘনা প্রিন্সেস। উসলুগা বন্দরে গেলে সেখানে জিপিএস জ্যামারের কবলে পড়ে পথ হারিয়ে সমুদ্রতলে থাকা পাথরের পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তলা ফেটে যায় জাহাজটির। এতে জাহাজের কয়েকটি ট্যাংকে পানি ঢুকে পড়ে ও প্রপেলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অন্যদিকে মেঘনা প্রেস্টিজ নামক অপর জাহাজটি আইনি জটিলতায় গত ২৯ জানুয়ারি থেকে আাটকা পড়েছে ভেনিজুয়েলায় পুয়ের্তো ওরদাজ বন্দরে। জাহাজটির ক্যাপ্টেন এখনও পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দুই জাহাজের নাবিকরাই সুপেয় পানি ও খাদ্য সংকটে ভুগছেন।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে স্থির জাহাজে আটকে থাকায় একদিকে যেমন নাবিকদের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে নাবিকদের স্বজনদের।

জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম টিবিএসকে বলেন, উভয় জাহাজ ও তাদের ক্রুদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। শীঘ্রই সমস্যার সমাধান হবে। 

খাদ্য ও পানি সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দুটি জাহাজই বন্দরে বা তার আশেপাশে আছে। তাই খাদ্য বা পানি সংকট হওয়ার কথা না। টাকা দিলেই এসবের সরবরাহ পাওয়ার কথা।’ 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার কবলে পড়া মেঘনা প্রিন্সেসকে উদ্ধার করে মেরামত করতে অন্তত তিন মাস লাগবে। অন্যদিকে আইনি জটিলতায় আটকে পড়া জাহাজ ছাড়াতে ছয় থেকে আট মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

২০১৯ সালে একটি বাংলাদেশি জাহাজ গিনিতে একই ধরনের আইনি জটিলতায় পড়ে প্রায় আট মাস আটকে ছিল।

আরেকটি পৃথক ঘটনায় কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন এমভি আব্দুল্লাহ নামের একটি জাহাজ সোমালি দস্যুদের অপহরণের শিকার হয় ২০২৪ সালের মার্চে। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পওয়ার প্রায় দুই মাস পর জাহাজটি দেশে ফিরে আসে।

বাল্টিক সাগরে মেঘনা প্রিন্সেসে কী হয়েছে?

সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ২৫ হাজার টান সার লোড করে আরও ২৫ হাজার টন কার্গো লোড করার জন্য উসলুগা নামের একটি রাশিয়ান পোর্টে গেলে সেখানে জিপিএস জ্যামারের কবলে পড়ে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর পথ হারিয়ে সমুদ্রতলে থাকা পাথরের পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে তলা ফেটে যায় মেঘনা প্রিন্সেসের। এতে জাহাজের কয়েকটি ট্যাংকে পানি ঢুকে পড়ে ও প্রপেলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

এরপর থেকে বারবার সাহায্যের আবেদন পাঠালেও রুশ বন্দর কর্তৃপক্ষ এক সপ্তাহ পর্যন্ত কোনো ধরনের সাহায্য পাঠায়নি বলে জানিয়েছে বিএমএমওএ। জাহাজে তীব্র পানি ও খাদ্য সংকটে পড়েছেন নাবিকরা। 

বিএমএমওএর সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘স্থানীয় বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানোর পরও তারা কোনো রেসপন্স করেনি। পরে জাহাজের নাবিকরা নিজেরা খতিয়ে দেখেন, জাহাজের তলায় ফাটল ধরেছে ও কয়েকটি ট্যাংকে পানি প্রবেশ করেছে। তবে ভাগ্যক্রমে কার্গো অক্ষত আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওই দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ পর একটি ডুবুরি দল এসে পর্যবেক্ষণ করে দেখে জাহাজটি একটি পাথরের সাথে আটকে গেছে ও প্রপেলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কার্গো খালি করার পর ড্রাফ্ট কিছুটা কমলে জাহাজটি ভেসে উঠলে সেটিকে টাগ দিয়ে টেনে ডক ইয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে মেরামত করতে হবে, যা বেশ সময়সাপেক্ষ।’

ক্যাপ্টেন আনাম আরও বলেন, জাহাজটির চিফ জানিয়েছেন, সব নাবিক গত ২ মাস ধরে বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন। বিশুদ্ধ পানির সংকটে তারা ডেক ও অন্যান্য এলাকা থেকে তুষার সংগ্রহ করেন। ক্রুরা এখন অস্থির হয়ে আছেন।

বিএমএমওএ, আন্তর্জাতিক পরিবহন শ্রমিকদের সংস্থা আইটিএফ ও মেঘনা গ্রুপের দীর্ঘ কয়েক মাসের চেষ্টা ও তদবিরের পর গত সপ্তাহে একটি রুশ স্যালভেজ কোম্পানি জাহাজটি উদ্ধারের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। শিগগিরই জাহাজ উদ্ধার করে নিয়ে মেরামতের কাজ শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী।

মেঘনা প্রেস্টিজ কীভাবে আইনি জটিলতায় জড়াল?

মেঘনা প্রেস্টিজ বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজটি ২৫ জন নাবিক নিয়ে আইনি জটিলতায় গত ২৯ জানুয়ারি থেকে আাটকা পড়েছে ভেনিজুয়েলায় পুয়ের্তো ওরদাজ বন্দরে।

কার্গো লোড করার পর জাহাজটি ছেড়ে আসার আগে আন্ডারওয়াটার ইন্সপেকশনের সময় প্রপেলারের আঘাতে একজন ডুবুরি মারা যাওয়ার পর দেশটির পুলিশ জাহাজটির ক্যাপ্টেনকে আটক করে নিয়ে যায়। ভেনিজুয়েলার একটি আদালত দুর্ঘটনার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক্যাপ্টেনকে ৪৫ দিনের আটকাদেশ দিয়ে পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়।

জাহাজটিতে বর্তমান ১০-১৫ দিনের খাদ্য মজুত থাকলেও পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

জাহাজ মালিকদের সংগঠন পিঅ্যান্ডআই ক্লাব ও মালিক কর্তৃপক্ষ থেকে দুজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং আইনি জটিলতা সমাধানে আইএমওর সহায়তা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জাহাজটির ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান ফোনে টিবিএসকে বলেন, ‘গত ১২ জানুয়ারি মেঘনা প্রেস্টিজ নিয়ে ভেনিজুয়েলার বোচা গ্রান্ডে অ্যাঙ্করেজে আয়রন ওর লোড করার জন্য পৌঁছাই। কার্গো লোডিং শেষ হয় ২৯ তারিখ সকালে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় নিয়ম অনুসারে, বন্দর ত্যাগের পূর্বে জাহাজের আন্ডারওয়াটার ইন্সপেকশন বাধ্যতামূলক। যথারীতি ২৯ তারিখ দুপুরে অ্যান্টি-ড্রাগ অথরিটি ও ডুবুরি দল আসে। তাদের সঙ্গে আমার মিটিং হয়। কিন্তু ডুবুরি দলের ইনচার্জ ইংরেজিতে কথা বলতে না পারায় বোর্ডিং এজেন্ট নিজে থেকেই ইন্টারপ্রেটার হিসেবে কাজ করেন। 

‘ইন্সপেকশন শুরু করার আগে কিছু রুটিন কাজ বাকি ছিল। কিন্তু ডাইভিং টিম কোনোটি না করেই কাজ শুরু করে দেয়। এমতাবস্থায় বাতাসের কারণে জাহাজ ভেসে যেতে শুরু করে, যার দরুন ডিউটি অফিসার ইঞ্জিন চালু করেন খুব অল্প সময়ের জন্য। পরবর্তীতে দুপুরে ডুবুরি দলের ইনচার্জ ও এজেন্ট ব্রিজে এসে বলেন, তাদের একজন ডুবুরি আহত হয়েছেন।’ 

ক্যাপ্টেন বলেন, ‘এরপর ৩০ তারিখ বিকালে আমাকে জাহাজ থেকে থানায় নিয়ে যায়। থানায় আনার পর আমার বিরুদ্ধে কেস ফাইল করা হয় খুব জোরালোভাবে। আমাকে থানার পাশে একটি কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে খুব মানবেতর জীবন পার করছি। আমাদের কোম্পানি ইতিমধ্যে দুজন আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে।’

মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, মালিকপক্ষ থেকে জাহাজে নতুন আরেকজন ক্যাপ্টেন দেওয়া হয়েছে। তবে জাহাজে ১০-১৫ দিনের খাদ্য মজুত থাকলেও পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

আনাম চৌধুরী বলেন, মেঘনা প্রেস্টিজের বিষয়টি জানার পর বিএমএমওএ আন্তর্জাতিক পরিবন শ্রমিকদের সংগঠন আইটিএফ ও আইএমওকে জানিয়েছেন। তারা আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়ায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে আটকে থাকা জাহাজের অবস্থা বেশি খারাপ। বাইরে প্রচন্ড শীত। খাদ্য ও পানি সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন নাবিকরা। মেঘনা গ্রুপ চেষ্টা করছে সমস্যা সমাধানের। তবে সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত।’

কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম টিবিএসকে বলেনন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভেনিজুয়েলাতে আটকে থাকা জাহাজটি ছাড়িয়ে নিতে ও থানায় আটক ওই জাহাজের ক্যাপ্টেনকে দায়মুক্তি দেয়ার বিষয়ে সেদেশের সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আশা করছি খুব শিগগিরই একটা ফলাফল পাওয়া যাবে।’ 

রাশিয়ায় আটকে পড়া জাহাজের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওই জাহাজটি উদ্ধারে একটি উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এটাকে উদ্ধার করে একটি ডক ইয়ার্ডে নিয়ে মেরামত করা হবে।’ 

মেঘনা গ্রুপের শিপিং কোম্পানির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, ‘জাহাজ দুটি উদ্ধারে আমরা দিন-রাত ব্যস্ত সময় পার করছি। তাই এই বিষয়ে এখনই কিছু জানানো সম্ভব না।’

source : tbsnews

Comments are closed.