search the site
পায়রা বন্দরের উন্নয়নের নামে ব্যাপক অনিয়ম

পায়রা বন্দরের উন্নয়নের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। পায়রা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে যে তিনটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলোতে দুর্নীতি হয়েছে ব্যাপক। ঐ তিনটি প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়টি মন্ত্রণালয় তদন্ত করবে বলে জানা গেছে। প্রকল্পগুলো হচ্ছে—ডেভেলপমেন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড সাপোর্ট ফ্যাসিলিটিজ, ক্যাপিটাল অ্যান্ড মেনটেইনেন্স ড্রেজিং স্কিম, পায়রা পোর্ট ফার্স্ট টার্মিনাল অ্যান্ড কানেকটিভিটি প্রজেক্ট। এই তিনটি প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় সংশোধন করে টাকার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরেও তা পায়রা বন্দরের কোনো কাজে আসেনি। বন্দরের নাব্য এখনো ছয় মিটার থেকে সাত মিটারেও দাঁড়ায়নি। এর ফলে বন্দরের পরিচালনা কার্যক্রম ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। পায়রা বন্দরের কতিপয় দুষ্কৃতকারী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এসব অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে জানা গেছে।
ক্যাপিটাল অ্যান্ড মেনটেইনেন্স ড্রেজিং প্রকল্পে লুটপাট
এ প্রকল্পটির ব্যয় ছিল সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) বেলজিয়াম ভিত্তিক জান ডে নুল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়। প্রকল্পটির কার্যাদেশ সরকারি সকল নিয়মনীতি অনুসরণ না করেই করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। কোম্পানির সঙ্গে তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠদের সম্পর্ক ছিল বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বন্দরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. নাসির উদ্দিন, পায়রা বন্দরের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানদের যোগসাজশে এবং মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ডিপিএম পদ্ধতিতে চুক্তি করা হয়। জানা যায়, এই প্রকল্প থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
পিপিএ গাইডলাইন অনুযায়ী কোনো বিদেশি কোম্পানিকে ডিপিএম পদ্ধতিতে সরাসরি কার্যাদেশ দেওয়ার বিধান নেই। চ্যানেলটির ডিজাইনের জন্য নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সিডিআর ইন্টান্যাশনাল কোম্পানিকে নিয়োগ প্রদান করে উক্ত সিন্ডিকেট। অনুমোদিত চ্যানেল ডিজাইন অনুযায়ী চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ৭৫ কিলোমিটার এবং গভীরতা ৯ দশমিক ৩ মিটার। প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও নির্দিষ্ট গভীরতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া চ্যানেলের ড্রেজিং করা হয়েছে ৭০ কিলোমিটার। কিন্তু কাজ না করেই ঠিকাদার সকল অর্থ উত্তোলন করে নেয়। সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে দেশীয় কোম্পানি ইনফ্রাদেব টেকনোলজি লিমিটেডকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সিন্ডিকেটের কারণে হপার ড্রেজার ক্রয়কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করে কর্ণফুলী শিপইয়ার্ডকে ক্রয় আদেশ দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের ৬ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হতে বৈদেশিক মুদ্রা নগদায়ন করে বিল পরিশোধ করা হয়। চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পরও মাত্র এক বছরের মধ্যে বন্দরের বর্তমান গভীরতা ৬ মিটারের নিচে।
পায়রা পোর্ট ফার্স্ট টার্মিনাল প্রকল্পে দুর্নীতি
এই প্রকল্পের পরিচালক হলেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) মো. নাসির উদ্দিন। প্রকল্পটির ব্যয় ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রকল্পটি ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও যৌক্তিক কারণ ছাড়া বিভিন্ন কম্পোনেন্টের উল্লেখযোগ্য হারে খরচ প্রায় ১ হাজার কোটি বাড়িয়ে কার্যকাল বাড়ানো হয়। কাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ জেটির পাইলিং অনুমোদিত ডিজাইন অনুযায়ী স্টিলের পরিবর্তে কংক্রিটের পাইলিংয়ের বিষয়ে কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। এখানেই কয়েক শ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। এই প্রকল্পের পরিচালকের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত থাকায় জেটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাইলিংয়ের দরপত্রদাতা স্টিল পাইলের পরিবর্তে কংক্রিট পাইল দিয়ে কাজ শেষ করে। কিন্তু দরপত্রে সুস্পষ্টভাবে স্টিল পাইল সরবরাহ করার কথা উল্লেখ রয়েছে। সকল দরপত্রদাতা স্টিল পাইল সরবরাহের জন্য দরপত্র দাখিলও করেছে। কিন্তু ঠিকাদার অনুমতি ছাড়াই প্রায় ১ হাজার ৪৫০ স্টিল পাইল পরিবর্তন করে কংক্রিট পাইল দিয়ে কাজ করে। প্রকল্পের আওতায় টার্মিনাল ব্যাকআপ ইয়ার্ডে ডিপিপি অনুযায়ী ০ দশমিক ৮ এফএম সাইজের চাঁদপুর কোয়ালিটির বালুর মাধ্যমে ভরাটের কথা থাকলেও ঠিকাদার ০ দশমিক ৫ সাইজের নিচের লোকাল বালু দিয়ে ভরাট করেছে। টার্মিনাল ব্যাকআপ ইয়ার্ডের সঙ্গে বরিশাল কুয়াকাটা হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত নির্মাণাধীন রাস্তার ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে যোগসাজশে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।
অন্যদিকে পায়রা বন্দরের বাউন্ডারি দেওয়াল এক বছর আগে ধসে পড়লেও সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের কারণে কোনো তদন্ত কমিটি হয়নি। এ সকল অপকর্মে চিফ ইঞ্জিনিয়ার নাসির উদ্দিন সরাসরি জড়িত বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলাও চলমান।
প্রসঙ্গত, পায়রা বন্দর দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর যা পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় অবস্থিত। বন্দরটি ২০১৩ সালে উদ্বোধন করা হয়। ২০১৬ সালে এস টি এস পদ্ধতিতে নোঙরে স্বল্প পরিসরে জাহাজে মালামাল পরিবহন কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর মাধ্যমে সরাসরি কয়লা খালাস কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময় হতে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রকার মালামালসহ বাণিজ্যিক জাহাজের আগমন অব্যাহত রয়েছে।
source : ittefaq