১৪ বছরে অনিয়মই হয়েছে নিয়ম

Comments Off on ১৪ বছরে অনিয়মই হয়েছে নিয়ম

বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির প্রকৌশলী সাজিদ হোসাইন ২০০৩ সালে প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। তাঁর আমলে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হওয়ার প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। পরে তাঁকেই সাত দফায় ১৪ বছর মেরিন একাডেমির সর্বোচ্চ কমান্ড্যান্ট পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তবুও বিগত সরকারের পছন্দের মানুষ হওয়ায় বার বার শীর্ষ পদে ‘অটো চয়েস’ হয়েছেন তিনি। সরকার পতনের পাঁচ দিন পর কমান্ড্যান্টের পদ ছেড়েছেন এই কর্মকর্তা। কিন্তু পদ ছাড়ার আগে প্রায় ১০ মাস দখল করে রেখেছিলেন তিনি সরকারি বাংলো ও গাড়ি। এমন সব ঘটনা ঘটে মেরিটাইম সেক্টরে। দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি এই প্রতিষ্ঠানকে একাই ডুবিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

এদিকে সাজিদের স্থলে নতুন কমান্ড্যান্ট করা হয়েছিল ক্যাপ্টেন কাজী এবিএম শামীমকে। অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনিও। তিন নম্বর গ্রেডের কমান্ড্যান্টের পদ ছেড়ে আরও দুই ধাপ নিচের পদে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাউন্সিলর (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স) পদে যোগ দিয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যে। নৌ সেক্টরে ক্যাডেট তৈরির গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটি এখন চালাচ্ছেন অনেক নিচের পদের একজন নৌ-শিক্ষাপ্রধান। তাও ভারপ্রাপ্ত কমান্ড্যান্ট হিসেবে নন; রয়েছেন অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে। তাই থমকে আছে প্রশাসনিক কার্যক্রম। বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির এমন বেহাল দশার নেপথ্যে আছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও দলপ্রীতি। 
চট্টগ্রাম শহরের ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে জলদিয়া এলাকায় কর্ণফুলী নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত মেরিন একাডেমি। এখানে বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাডেট, ডেক অফিসার এবং মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দুই বছরের তত্ত্বীয় কোর্স শেষ করে এক বছর সমুদ্রগামী জাহাজে প্রশিক্ষণ নিতে হয় ক্যাডেটদের। এর পর তারা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরে পরীক্ষা দিয়ে কর্মকর্তা হিসেবে জাহাজে মূল কর্মজীবন শুরু করতে পারেন। ক্যাডেটদের জাহাজে প্রশিক্ষণের জন্য মূল ভরসা দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ। এখানে চাকরির সুযোগ আছে মাত্র ২৬০ জনের। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক একাডেমি হওয়ায় এখন প্রতিবছরই চার গুণ ক্যাডেট বের হচ্ছেন। ফলে প্রতি বছর বাড়ছে বেকার ক্যাডেটের সংখ্যা। 
নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সম্প্রতি সফর করেছেন মেরিন একাডেমিতে। এ সময় তিনি বলেছেন, এই সেক্টর গত ১৫ বছর ঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি। প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনা। 

যত্রতত্র মেরিন একাডেমি খোলা প্রসঙ্গে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই কোনো সমীক্ষা না করেই একের পর এক বেসরকারি মেরিন একাডেমির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ জন্য বেকার ক্যাডেটের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এখন নিয়মের আওতায় আনা হচ্ছে এ সেক্টরকে। তবে মেরিন একাডেমির সাবেক কমান্ড্যান্ট ড. সাজিদ ও যুক্তরাজ্যে থাকা শামীম সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। 
মেরিন একাডেমির কমান্ড্যান্ট পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা নৌ-শিক্ষা প্রধান ক্যাপ্টেন মো. ইবনে কায়সার তৈমুর বলেন, আমার অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। 

 যেভাবে ক্ষমতা পোক্ত করেন ড. সাজিদ
সব রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে ১৪ বছর চুক্তিতে ছিলেন সাবেক কমান্ড্যান্ট সাজিদ হোসাইন। ২০০৩ সালে প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় বহিষ্কৃত হন তিনি। হাইকোর্টে রিট পিটিশনের মাধ্যমে আরও কিছুদিন চাকরি করে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ২০০৫ সালে পদত্যাগ করে সব পাওনা বুঝে নেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আলাদীনের চেরাগ পান তিনি। ২০০৯ সালে কমান্ড্যান্ট পদে যোগদান করে ২০১২ সালে ডেপুটি কমান্ড্যান্ট পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় তাঁকে। একই বছর তাঁকে আবার কমান্ড্যান্ট পদে ফের পদোন্নতি দেওয়া হয়। ২০০৯ সাল থেকে ড. সাজিদ কমান্ড্যান্ট পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সপ্তম দফা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। ওই দিনই প্রতিষ্ঠানটির নৌ-শিক্ষাপ্রধানকে তাঁর নিজ দায়িত্বের বাইরে কমান্ড্যান্টের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে নৌ-মন্ত্রণালয়। এই প্রজ্ঞাপনের পরই ইঞ্জিনিয়ার সাজিদ নিজ উদ্যোগে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে পেছনের তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর দেখিয়ে একটি সার্কুলার জারি করেন। এটি করে তিনি তাঁর চুক্তির মেয়াদ অষ্টমবারের মতো বর্ধিত করার চেষ্টা করেন। প্রায় ১০ মাস দখলে রাখেন সরকারি বাংলো ও গাড়ি। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় কেউ এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি তখন। সরকার পতনের পাঁচ দিন পর সেই বাংলো ছাড়েন তিনি। সাজিদ হোসাইন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি ৭ নম্বর সেক্টরে মধুপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে দাবি করেন।
২০১৪ থেকে ২০২১ সালের একটি অডিট রিপোর্টের নিরীক্ষায় ৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার অনিয়মের চিত্র ফুটে উঠেছে। তখন দায়িত্বে ছিলেন ড. সাজিদ। এ ব্যাপারে নিরীক্ষা কমিটি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। এক সময় বরখাস্ত হওয়ার পর কীভাবে বারবার  চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেলেন তার জবাবও দিতে পারেননি। 

যেভাবে তিনি বাড়িয়েছেন বেকারত্ব 
দেশে মোট পাঁচটি সরকারি মেরিন একাডেমি আছে যেগুলো থেকে পাস করে সরাসরি ক্যাডেটরা জাহাজে যোগদান করতে পারেন। একই সুযোগ পান মেরিন ফিশারিজ একাডেমির ক্যাডেটরাও। এর বাইরে সাতটি নিবন্ধিত প্রাইভেট একাডেমি আছে, যারা সিডিসি নিয়ে সরাসরি যোগদান করতে পারেন জাহাজে। মার্চেন্ট মেরিনারদের একটি অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ২০২২-২৩ সালে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছে ৫৪৬ জন। যার মধ্যে বেকার হয়ে রয়েছে অন্তত ৪০০ জন। চলতি মাসেই চট্টগ্রামের মেরিন ও ফিশারিজ একাডেমি থেকে আরও ৪০০ জন ক্যাডেট পাস করবে। এটি যুক্ত হলে বেকার ক্যাডেটের সংখ্যা হবে ৮০০। বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ আছে ১০০টি। এগুলোতে সর্বোচ্চ ২৬০ জন ক্যাডেটের চাকরি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি মিলে প্রতি বছর পাস করছেন তিন থেকে চার গুণ বেশি সংখ্যক ক্যাডেট। 
এদিকে কোনো সমীক্ষা না করেই মেরিন একাডেমিতে নারী ক্যাডেট ভর্তি করা হচ্ছে। ড. সাজিদের আমলে শুরু হওয়া এ কার্যক্রম এখনও চলছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে ৯৫ জন নারী ক্যাডেট প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে পেশায় আছেন মাত্র ৪৯ জন। আবার মেরিন ফিশারিজ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৯ জন নারী ক্যাডেটের মধ্যে পেশায় আছেন মাত্র ৮ জন। চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে গত ৬১ বছরে ৫ হাজার ৯৭ জন ক্যাডেট ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে গত ১০ বছরে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৬১ জন। 

রাজনৈতিক বিবেচনায় মেরিন একাডেমি 
প্রয়োজন না থাকলেও একের পর এক মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সারাদেশে। চট্টগ্রামে ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের পর মাদারীপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী এবং মেহেরপুরেও ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। সাজিদের সময়কালে প্রয়োজন ছাড়াই রংপুর, পাবনা, বরিশাল ও সিলেটে চারটি নতুন সরকারি মেরিন একাডেমি হয়েছে। সারাদেশে হয়েছে দেড় ডজনেরও বেশি বেসরকারি মেরিন একাডেমি। কিন্তু এসব শিক্ষার্থীর ৮০ শতাংশই থাকছে বেকার। 

যা বললেন ড. সাজিদ
সদ্য দায়িত্ব ছাড়া মেরিন একাডেমির কমান্ড্যান্ট ড. সাজিদ হোসাইন সমকালকে বলেন, আমার সময়ে মেরিন সেক্টরে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। আমি কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। বেসরকারি একাডেমি অনুমোদনের কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়। সেখানে আমার কোনো ভূমিকা নেই।
সরকারি বাংলো ও গাড়ি না ছাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চাকরি ছাড়ার পরও এক বছর সব রকম সুবিধা ভোগ করতে পারে একজন সরকারি কর্মকর্তা। এখানে দোষের কিছু নেই। ৪ কোটি টাকার অনিয়ম প্রসঙ্গে বলেন, সত্যিকার অর্থে কোনো অনিয়ম হলে আমার বিরুদ্ধে তখন কেন ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। টানা ১৪ বছর দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গে সাবেক এই কমান্ড্যান্ট বলেন, যোগ্যতা বলেই দায়িত্ব পালন করেছি। বিগত সরকারের সঙ্গে আমার কোনো বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। 

source : samakal

Comments are closed.