মুখোমুখি বন্দর-বিজিএমইএ

0 comments

আমদানি পণ্য বোঝাই কনটেইনার ডেলিভারি কোথা থেকে নেবে তা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। বিশ^মানের বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরকে গড়ে তুলতে আমদানি পণ্য অফডকে স্থানান্তর করতে চাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে অফডক থেকেই সব পণ্য ডেলিভারি হবে। কিন্তু এর বিরোধিতা করছে বিজিএমইএ। ইতিমধ্যে সংগঠনটির পক্ষ থেকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদনও জানানো হয়েছে। সংগঠনটি বন্দর থেকেই পণ্য ডেলিভারি নিতে চায়।

পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর মতে, বন্দরের ইয়ার্ড এড়িয়ে অফডক  থেকে কনটেইনার ডেলিভারি নিলে খরচ যেমন চারগুণ বাড়বে তেমনি সময় ক্ষেপণ হবে তিনগুণ। বছরে যার আর্থিক ক্ষতির মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বতর্মানে ২০ ফুট সাইজের এক কনটেইনার পণ্য বন্দর থেকে ডেলিভারি নিতে খরচ পড়ছে ৩ হাজার ৩০০ টাকা, আর ৪০ ফুট সাইজের কনটেইনারের ক্ষেত্রে খরচ ৪ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু বন্দরের পরিবর্তে অফডক থেকে ডেলিভারি নিলে খরচ বেড়ে হবে যথাক্রমে ১২ হাজার ৬০৫ টাকা এবং ১৪ হাজার টাকা।  

বছরে চট্টগ্রাম বন্দর ৩২ লাখের বেশি কনটেইনার এবং ১২ কোটি মেট্রিক টন বাল্ক পণ্য হ্যান্ডলিং করছে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামালের পাশাপাশি রপ্তানির জন্য প্রস্তুতকৃত তৈরি পোশাক। আমদানিকৃত কাঁচামাল অফডক থেকে ডেলিভারি নেওয়ার বিধান চালু হলে খরচের পাশাপাশি সময়ও বাড়বে বলে শঙ্কিত গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে বন্দর থেকে সর্বনিম্ন একদিনে ডেলিভারি নিতে পারছেন আমদানিকারকরা।  

বিজিএমইএর প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের ১১ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আমদানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার জন্য অফডকগুলোতে পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট নেই। বর্তমানে ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য অফডকের মাধ্যমে ডেলিভারি নেওয়ার বিধান থাকায় সেগুলোও যথাসময়ে ডেলিভারি দিতে পারে না অফডকগুলো। এছাড়া বিদ্যমান ১৮টি অফডকের মধ্যে দুই বা তিনটি ছাড়া প্রায় সব অফডকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। অনেকের সীমানা প্রাচীরও নেই। আমদানি পণ্য অফডকে স্থানান্তরের বিষয়ে বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যদি অফডক থেকে আমদানি পণ্য ডেলিভারি নিতে হয় তাহলে আমার একটি প্রতিষ্ঠানেই বছরে প্রায় এক কোটি টাকার বেশি খরচ হবে। এভাবে অতিরিক্ত খরচ দিয়ে কি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব?’

বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এদিকে গত ১৪ অক্টোবর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সব এফসিএল (পণ্যভর্তি কনটেইনার) কনটেইনার স্থানান্তর এবং অফডক থেকে ডেলিভারির ব্যবস্থা করতে চিঠি দেওয়া হয়। এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বরাবরও একই ইস্যুতে চিঠি দিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই ইস্যুতে ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান কমডোর এম আনোয়ারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে আগামী এক বছরের মধ্যে অফডকগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে সব পণ্য অফডক থেকে ডেলিভারি নেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব কনটেইনার অফডকে স্থানান্তর করতে চায়। এর কারণ হিসেব বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘একটি বন্দরের গতিশীলতা অব্যাহত রাখতে ফ্রি স্পেস প্রয়োজন। এতে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যগুলো দ্রুত এক স্থান থেকে অপর স্থানে স্থানান্তর সহজ ও দ্রুত হয়। কিন্তু এসব কনটেইনারের কারণে বন্দরের স্বাভাবিক কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় চার হাজারের বেশি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান বন্দরে প্রবেশের কারণে ভেতরে ও বাইরে যানজট হচ্ছে। নগরবাসীর ভোগান্তি হচ্ছে। আমরা এই অবস্থা থেকে মুক্তি চাই। এজন্য অবশ্যই রপ্তানি পণ্যের মতো শতভাগ আমদানি পণ্য অফডক থেকে ডেলিভারি নেওয়ার অনুমোদন দিতে আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি।’

কিন্তু বিজিএমই বলছে তারা বন্দর থেকে নিতে চায়। এ বিষয়ে বন্দরের বক্তব্য কী? এর উত্তরে ওমর ফারুক বলেন, ‘বন্দর থেকে নেবে না অফডক থেকে নেবে এটা সিদ্ধান্ত দেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। আমরা অতীতেও বলে এসেছি এখনো বলছি সব পণ্য অফডক থেকে ডেলিভারি দেওয়ার জন্য। বর্তমানে ৩৮টি আমদানি পণ্য অফডক থেকে দেওয়া হয়ে থাকে।’

বিকডার বক্তব্য : ১৮টি অফডকের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, ‘বন্দরের অভ্যন্তর, অফডক এবং আমদানিকারকের নিজস্ব কারখানা এই তিনটি মাধ্যম উন্মুক্ত করে দেওয়া  হোক। আমদানিকারক যেখানে নিজের জন্য কমফোর্ট অনুধাবন করবেন সেখান থেকেই পণ্য ডেলিভারি নেবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা রয়েছে এবং আমরা আরও উন্নত করছি নিজেদের ইয়ার্ডগুলো। যদি সব আমদানি পণ্য অফডকে দেওয়া হয় তাহলে ব্যবসার প্রসার ঘটবে এবং নতুন নতুন অফডক যেমন গড়ে উঠবে তেমনিভাবে বিদ্যমান অফডকগুলো আধুনিক ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করবে।’

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮ একক কনটেইনার। এরমধ্যে গড়ে ৪০ হাজার ৫১০ কনটেইনার জমা থাকে যা বন্দরের ৭৫ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকে। বাকি ২৫ শতাংশ জায়গায় আমদানিকৃত পণ্য (এফসিএল কনটেইনার) কনটেইনার থেকে খুলে ডেলিভারি দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে প্রায় ৩২ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে। এসব কনটেইনারের মধ্যে প্রায় ২২ লাখ কনটেইনার আমদানি-রপ্তানি পণ্যের এবং বাকি কনটেইনারগুলো খালি কনটেইনার। হ্যান্ডলিংকৃত ২২ লাখ কনটেইনারের মধ্যে এলসিএল (বাল্ক পণ্য) কনটেইনার থাকে প্রায় ৫০ হাজার। অবশিষ্ট প্রায় ২১ লাখ ৫০ হাজার কনটেইনারের মধ্যে আমদানি পণ্যের এফসিএল কনটেইনার প্রায় ১৪ লাখ ৫০ হাজার ও রপ্তানি পণ্যের এফসিএল কনটেইনার প্রায় ৭ লাখ। বর্তমানে রপ্তানি পণ্যের ৭ লাখ বেসরকারি ১৮টি কনটেইনার ডিপো থেকে বন্দরে জাহাজীকরণ হয়ে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ৩৮ আমদানি পণ্যের আরও প্রায় দুই থেকে তিন লাখ কনটেইনার। তাহলে এখন দেখা যাচ্ছে আমদানি রপ্তানির ২২ লাখ এফসিএল কনটেইনারের মধ্যে ১০ লাখ অফডকগুলো হ্যান্ডেল করার পর অবশিষ্ট আরও ১২ লাখ কনটেইনার অফডকগুলোকে হ্যান্ডলিং করতে হবে। যদিও অতিরিক্ত এই কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার ক্ষমতা তাদের নেই। সেক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে আইটেমের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে বলে শিপিং খাতের একাধিক কর্মকর্তা জানান।

source : bgmea

Leave a Reply