চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মচাঞ্চল্য

Comments Off on চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মচাঞ্চল্য

জেটিতে নোঙর করা সব বিশালাকার সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ। প্রতিটি আড়াই থেকে ৩ হাজার টিইইউএস (২০ ফুট সমমান) কনটেইনার বহন করতে সক্ষম। কনটেইনারের ওজন ছাড়া শুধু এর ভিতরে পণ্যই থাকে ২৭-৩০ টন।

চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে প্রতিদিন ১৬-১৭টি জাহাজে পণ্য লোড-আনলোড হয়। আমদানি পণ্য খালাসের পর জাহাজগুলো রপ্তানি পণ্য বোঝাই করে চলে যায় বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর ঘিরে প্রতিদিন চলে ১০-১৫ হাজার মানুষের এক মহাকর্মযজ্ঞ। চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালসহ অবকাঠামো গড়ে উঠেছে মূলত কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে। বর্তমানে জিসিবি, সিসিটি, এনসিটি ও পিসিটি নামে বন্দরের চারটি টার্মিনাল রয়েছে। যেখানে জেটি আছে মোট ২২টি। জেটি ছাড়াও বহির্নোঙরে লাখ লাখ টন পণ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি জাহাজ। জেটির মতো বহির্নোঙরে অর্থাৎ গভীর সমুদ্রেও চলে খালাস কার্যক্রম। গভীরতা কম থাকায় বড় জাহাজগুলো (১০ মিটার ড্রাফটের বেশি হলে) সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারে না। তাই এসব জাহাজ থেকে বহির্নোঙরে পণ্য খালাস করতে হয়। বহির্নোঙরে প্রতিদিন অপেক্ষমাণ থাকে ৫০-৫২টি জাহাজ। জেটি ও বহির্নোঙর মিলিয়ে গড়ে প্রতিদিন ৭০-৭৫টি জাহাজ অবস্থান করে এ বন্দরে।

দেশের অর্থনীতিতে প্রতিনিয়ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা চট্টগ্রাম বন্দর কখনো এক মিনিটের জন্যও ঘুমায় না। সপ্তাহের ৭ দিনই খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা। চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা হয় ‘সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার’, ‘দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন’। বাংলাদেশের সমুদ্রকেন্দ্রিক আমদানি-রপ্তানির ৯২ শতাংশই হয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। দেশের বাজেটের বড় একটি অংশের জোগানদাতা চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্ক আদায়ের দায়িত্ব পালন করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। প্রতিষ্ঠানটি গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদায় করেছে ৬৮ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকার রাজস্ব। একই অর্থবছরে দেশের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। কাস্টমসের আয় ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের চার্জ আদায় বাবদ চট্টগ্রাম বন্দর প্রতি বছর আয় করে বিপুল পরিমাণ অর্থ। বন্দর সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে খরচ বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যাক্সপূর্ব রাজস্ব উদ্বৃত্ত ছিল ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ২ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ট্যাক্সপূর্ব রাজস্ব উদ্বৃত্ত ছিল ২ হাজার ১০৫ কোটি, ২০২০-২১ এ ছিল ১ হাজার ৭৯৩ কোটি, ২০১৯-২০ এ ছিল ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ বন্দরের কার্যক্রম সপ্তাহের ৭ দিনই চলে। বন্দরের কার্যক্রম আগের চেয়ে অনেক বেশি গতিশীল। ২০২৪ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে রেকর্ড গড়তে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। ১২ শতাধিক ক্যামেরা দিয়ে সার্বক্ষণিক ইয়ার্ডের কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে।

প্রতি বছর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০০টি বন্দরের তালিকা তৈরি করে আন্তর্জাতিক শিপিংবিষয়ক ব্রিটিশ সাময়িকী ‘লয়েডস লিস্ট’। মোট পরিবহন করা কনটেইনারের সংখ্যার ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করা হয়। সাময়িকীটির ২০২৪ সালে প্রকাশিত তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৬৭তম। লয়েডস লিস্টের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর ২০২৩ সালে ৩০ লাখ ৫০ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছিল। এর আগের বছর যা ছিল ৩১ লাখ ৪২ হাজার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ১২ কোটি ৩২ লাখ মেট্রিক টন, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১১ কোটি ৮২ লাখ টন। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার কনটেইনার ডেলিভারি নেন আমদানিকারকরা। এ ছাড়া প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার কনটেইনার রপ্তানি পণ্য জাহাজে তোলা হয়। একই অর্থবছরে বন্দর জলসীমায় পণ্য ও কনটেইনারবাহী জাহাজ হ্যান্ডলিং হয় ৩ হাজার ৯৭১টি, যা আগের বছরে ছিল ৪ হাজার ২৫৩টি।

দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। কিন্তু সেই তুলনায় বাড়ছে না চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা। সর্বশেষ ২০০৭ সালে চালু হয়েছিল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো নতুন টার্মিনাল নির্মিত হয়নি। ২০২৪ সালে চালু হয়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। সীমিত পরিসরে নতুন টার্মিনালটিতে হ্যান্ডলিং শুরু হয়েছে। পুরোদমে অপারেশন শুরু হলে বছরে হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়বে প্রায় ৪ লাখ টিইইউএস কনটেইনার। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর দাবি দীর্ঘ দিন ধরেই জানিয়ে আসছেন ব্যবহারকারীরা (স্টেকহোল্ডার)। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মেগা প্রকল্প হিসেবে বে-টার্মিনাল, লালদিয়া টার্মিনাল ও কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ধীরগতি। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, আরও টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বে-টার্মিনালের কোনো বিকল্প নেই। যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে।

source : bd-pratidin

Comments are closed.