বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাডেট প্রশিক্ষনে কারা যোগ্য?

Comments Off on বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাডেট প্রশিক্ষনে কারা যোগ্য?

আবুল কালাম আজাদ

নৌ বাহিনীর কর্মকর্তারা  বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাডেট ট্রেনিং এর সাথে যুক্ত থাকা নিয়ে বির্ত্ক তৈরি হয়েছে।  নৌ বাহিনীর এক্সিকিউটিভ ব্রাঞ্চ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রাঞ্চের কর্মকর্তারা বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য কেন যোগ্য নয়, তা বোঝার জন্য প্রথমে বাণিজ্যিক জাহাজের পরিচালনা এবং প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মান এবং কনভেনশনগুলো বুঝতে হবে। এই মানগুলো আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (IMO) দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা মূলত STCW কনভেনশন (International Convention on Standards of Training, Certification and Watchkeeping for Seafarers) এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।

STCW কনভেনশনে নাবিকদের প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশনের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম এবং মানদণ্ড প্রদান করা হয়েছে, যা বাণিজ্যিক জাহাজের নির্দিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কনভেনশনের প্রধান কিছু শর্তাবলী  ভিত্তিতে নৌ বাহিনীর কর্মকর্তারা বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণের জন্য যোগ্য নয় বলে বিবেচিত হতে পারেন। কেন তারা যোগ্য নন সে কারনগুলো তুলে ধরা হলো।

১. বাণিজ্যিক ও সামরিক পরিচালনার মধ্যে পার্থক্য

নৌবাহিনীর এক্সিকিউটিভ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রাঞ্চের কর্মকর্তারা মূলত সামরিক জাহাজের পরিচালনা এবং নিরাপত্তা রক্ষায় প্রশিক্ষিত। সামরিক এবং বাণিজ্যিক জাহাজের পরিচালনার উদ্দেশ্য এবং কার্যকলাপের ধরনে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। সামরিক জাহাজগুলো মূলত প্রতিরক্ষা এবং সামরিক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার হয়, যেখানে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো পণ্য পরিবহন, যাত্রী পরিবহন, বা অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত হয়। বাণিজ্যিক জাহাজের জন্য STCW কনভেনশনে উল্লেখিত নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যা নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা সরাসরি অর্জন করেন না।

২. STCW কনভেনশনের প্রশিক্ষণ মানদণ্ড

STCW কনভেনশনের অধীনে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতে হলে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হয়, যেমন: প্রশিক্ষকের উপযুক্ত সার্টিফিকেশন থাকতে হবে যা বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়। প্রয়োজনীয় সেবার অভিজ্ঞতা থাকা বাঞ্ছনীয় যা বাণিজ্যিক জাহাজে কর্মরত থেকে অর্জিত হয়। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ মূলত সামরিক দিকের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা আলাদা।

৩. আইএমও কনভেনশনের অনুবর্তিতা

STCW কনভেনশন এবং অন্যান্য IMO নির্দেশনা বাণিজ্যিক নাবিকদের নিরাপত্তা ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য তৈরি। প্রশিক্ষক হতে হলে সংশ্লিষ্ট কনভেনশনগুলোর নিয়ম মেনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হওয়া জরুরি। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের এই ধরণের বাণিজ্যিক প্রশিক্ষণ এবং IMO নিয়মাবলী অনুযায়ী অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে তারা বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য যোগ্য বিবেচিত হন না। এই কারণগুলো একত্রে নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাদের বাণিজ্যিক ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ প্রদানে যোগ্য না হওয়ার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

এছাড়া, নৌ বাহিনীর এক্সিকিউটিভ ব্রাঞ্চ ও ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রাঞ্চের কর্মকর্তারা কেন বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ প্রদানে যোগ্য নন তা STCW কনভেনশন এবং সংশ্লিষ্ট IMO কনভেনশনগুলোর নির্দিষ্ট ধারা এবং রেফারেন্সের মাধ্যমে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। মূল কনভেনশনটি হলো:

১. STCW কনভেনশন, 1978 (Standards of Training, Certification, and Watchkeeping for Seafarers)

STCW কনভেনশনের রুল I/6: এটি নাবিকদের প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, এবং সার্টিফিকেশনের জন্য প্রয়োজনীয় মান নির্ধারণ করে। প্রশিক্ষক এবং মূল্যায়ক হিসেবে কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়েছে, যা সাধারণত বাণিজ্যিক জাহাজে কাজ করা ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য।

STCW কনভেনশনের রুল I/8 : এটি অভ্যন্তরীণ গুণমানের মানদণ্ড এবং প্রশিক্ষণ প্রদানকারীদের জন্য নির্দেশনা প্রদান করে। প্রশিক্ষক এবং মূল্যায়কদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় নির্দিষ্ট মান পূরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে যা সামরিক অভিজ্ঞতায় পুরোপুরি প্রযোজ্য নাও হতে পারে।

STCW কনভেনশনের রুল II/1: এটি বাণিজ্যিক জাহাজে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং যোগ্যতা নির্ধারণ করে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষকদের বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক। সামরিক জাহাজে কাজ করা ব্যক্তিরা এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেন না।

২. IMO Model Course 6.09 – Training Course for Instructors

এই মডেল কোর্স অনুযায়ী, প্রশিক্ষকদের অবশ্যই বাণিজ্যিক নাবিকদের প্রশিক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এটি STCW এর অধীনে প্রশিক্ষকগণের মান নিশ্চিত করার জন্য একটি নির্দেশিকা।

৩. STCW Code Section A-I/6

এই অংশে প্রশিক্ষক এবং মূল্যায়কদের জন্য নির্ধারিত যোগ্যতার মান সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটি বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষকদের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করে।

৪. STCW Code Section A-II/1

এই অংশটি ডেক অফিসারদের প্রশিক্ষণ এবং সার্টিফিকেশন সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করে। এর মধ্যে বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট জ্ঞান এবং দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা অন্তর্ভুক্ত। নৌ বাহিনীর কর্মকর্তারা এই ধরনের বাণিজ্যিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন না।

এই কনভেনশন এবং রেফারেন্সগুলো দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, বাণিজ্যিক ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষকদের বাণিজ্যিক জাহাজের অভিজ্ঞতা এবং STCW-এর অধীনে নির্দিষ্ট যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন। নৌ বাহিনীর এক্সিকিউটিভ ও ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রাঞ্চের কর্মকর্তারা সাধারণত সামরিক কার্যক্রমের জন্য প্রশিক্ষিত হন, যা বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।

অতীতের স্বৈরাচারী সরকার গায়ের জোরে বিভিন্ন নিয়ম বহির্ভূত কাজ করলেও বর্তমানে বিপ্লবী সরকারের আমলে তা চালিয়ে যাওয়া সমচীন নয় বলে মনে করেন এ সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিরা। 

অতীতে নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ম বহির্ভূত ভাবে ও আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে স্বৈরাচারী সরকার নৌ মন্ত্রনালয়ের বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োগ প্রদান করেন। যা সুস্পষ্ট ভাবে বৈষম্যমূলক ও অনধিকার চর্চা। বর্তমানে মেরিন একাডেমিগুলোতে যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থী পাওয়া না যাওয়ার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে 

 ১. আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পারিশ্রমিক না পাওয়া,

২. যোগ্য প্রার্থীদের মূল্যায়ন না করা।

সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধান না করে বিকল্প খোঁজা মানে মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার থিওরী এপ্লাই করা। সর্বোচ্চ পন্থা হবে বর্তমান বেতন কাঠামোতে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে, বেতন কাঠামো পরিবর্তন করা। তাতেও ফল পাওয়া না গেলে আইএমও তে যোগ্য প্রশিক্ষকের জন্য অনুরোধ পাঠানো। অতীতে, আইএমও থেকে এই ধরনের সহায়তা পাওয়ার নজির আছে। কিন্তু কোনো মতে আন্তর্জাতিক আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিয়ম বহিরভূতভাবে এমন কাউকে নিয়োগ প্রদান করা উচিত হবে না যার কারণে পুরা নৌ বাণিজ্য সেক্টরটি হুমকির মুখে পড়ে। বাংলাদেশ আইএমও এর কালো তালিকা ভুক্তির ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশেষ করো স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে যাতে দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। 

দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, যে সমস্ত একাডেমী গুলোতে যোগ্য কমান্ড্যান্ট নাই সে সমস্ত একাডেমীগুলোতে দ্রুততার সাথে দেশের প্রচলিত আইন ও আইএমও এর চাহিদা অনুযায়ী কমান্ড্যান্ট নিয়োগ করলে  দেশের ভাবমর্যাদা যেমন বাড়বে, তেমনি যোগ্য ক্যাডেট তৈরি হবে। 

Comments are closed.