search the site
‘ফাইনাল কথা, টাকা না দিলে আমাদের একে একে মেরে ফেলতে বলেছে’

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা (চিফ অফিসার) মো. আতিক উল্লাহ খান গতকাল মঙ্গলবার মাগরিবের পর মুঠোফোনে তাঁর স্ত্রীর কাছে একটি অডিও বার্তা পাঠিয়েছেন। অডিও বার্তাটি প্রথম আলোর হাতে এসেছে।
অডিও বার্তায় আতিক বলেছেন, ‘এই বার্তাটা সবাইকে পৌঁছে দিয়ো। আমাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে। তাঁদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে। এই বার্তাটা সবদিকে পৌঁছে দিয়ো।’
গতকাল রাতে আতিক উল্লাহ খানের নন্দনকাননের বাসায় গেলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো তাঁর বার্তাটি স্বজনেরা এই প্রতিবেদককে দেন।

মো. আতিক উল্লাহ খানছবি: সংগৃহীত
গতকাল বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টার দিকে জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাচ্ছিল। জলদস্যুদের কবলে পড়া চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের এই জাহাজটি পরিচালনা করছে গ্রুপটির সহযোগী সংস্থা এস আর শিপিং লিমিটেড। জাহাজে আতিক উল্লাহসহ ২৩ বাংলাদেশি নাবিক রয়েছেন। তাঁরা জিম্মি হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে নাবিকদের স্বজনদের।
আতিকের বাড়ি চন্দনাইশের বরকল এলাকায়। মা, স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি থাকেন শহরের নন্দনকানন এলাকায়। মা শাহানুর আকতার ছেলের চিন্তায় অস্থির। তিনি কখনো কাঁদছেন, কখনো-বা নামাজে দাঁড়িয়ে ছেলের জন্য দোয়াদরুদ পড়ছেন।
শাহানুর বলেন, মাগরিবের সময় ছেলের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়। তখন আতিক তাঁকে বলেছেন, তাঁদের ৫০ জন জলদস্যু ঘিরে রেখেছে। একটা কেবিনে বন্দী সবাই। তাঁদের সোমালিয়া নিয়ে যাচ্ছে। আড়াই দিনের মতো লাগবে ওখানে পৌঁছাতে। সবার জন্য দোয়া চেয়েছেন আতিক।
কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহানুর। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে ছেলের জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়ার কথা জানতে পারেন শাহানুর

আতিক উল্লাহ খানের মা ও দুই মেয়েছবি: প্রথম আলো
গতকাল বেলা একটার দিকে আতিক জলদস্যুদের কবলে পড়তে যাওয়ার বিষয়টি আঁচ করেছিলেন বলে ধারণা করছেন স্বজনেরা। সে সময় ফোনে আতিক তাঁর স্ত্রী মিনা আজমিনকে বলছিলেন, ‘কয়েক দিন আমাকে ফোনে পাবে না। আমি নেটওয়ার্কের বাইরে থাকব।’
নন্দনকাননের বাসায় বসে আতিকের ভগ্নিপতি ওমর ফারুক বলেন, তিনি হয়তো জলদস্যুদের জাহাজে ওঠার সময় ফোন দিয়ে ভাবিকে এ কথা জানিয়েছিলেন। পরিবার চিন্তা করবে বলে তিনি হয়তো জলদস্যুদের কথা বলেননি। পরে জানাজানি হলে পরিবারের সঙ্গে ফোনে দু-একবার পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়। অডিও বার্তাও পাঠান।
জাহাজের আরেক নাবিক তাঁর স্ত্রীকে ভিডিও পাঠালে সেখান থেকে মিনা আজমিনসহ পরিবারের সদস্যরা ঘটনা জানতে পারেন। সবাই তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। আতিকের স্ত্রী ও মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তাঁর দুই মেয়ে বাবার জন্য কাঁদছে।

স্ত্রী ও তিন সন্তানের সঙ্গে আতিক উল্লাহ খানছবি: সংগৃহীত
বড় মেয়ে ইয়াশরা ফাতেমার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মেজ মেয়ে উনাইজা পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ছোট মেয়ের বয়স দেড় বছর।
গতকাল মাগরিবের পর আতিক যখন শেষবার ফোন করেন, তখন স্ত্রী মিনা নামাজে দাঁড়িয়েছেন। তখন মেজ মেয়ে উনাইজা ফোন ধরে। আতিক মেয়েকে তখন শুধু বলেন, ‘আম্মুকে বোলো দোয়া করতে। আমাদের ফোন নিয়ে নিচ্ছে।’
অতটুকু বলেই ফোন কেটে দেন আতিক। এরপর অডিও ভয়েস হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান। আর ফোন খোলা পাওয়া যায়নি আতিকের।
১৪ বছর ধরে জাহাজে চাকরি করলেও কোনো সময় ছেলের এমন বিপদ আসেনি বলে জানান মা শাহানুর। তিনি দুই নাতনিকে জড়িয়ে সোফায় বসেছিলেন। স্বজনেরা একে একে বাসায় ভিড় করছিলেন।
শাহানুর বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানাচ্ছি। তিনিও একজন মা। আমার তিনটা ছোট ছোট নাতনি। ছেলেবউ অসুস্থ।’
আতিকের স্ত্রী মিনা এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর এমন বিপদের খবর শোনার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। গতকাল রাতে তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর গ্রুপটির জাহাজ ‘এমভি জাহান মনি’ ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তিন মাসের মাথায় মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি ছাড়িয়ে এনেছিল কবির গ্রুপ।
জিম্মি হওয়া জাহাজে খাবার আছে ২৫ দিনের

‘গোল্ডেন হক’ নামের জাহাজটি বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পর এর নাম হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’। জাহাজের ২৩ নাবিক সুস্থ আছেন বলে কেএসআরএম গ্রুপ জানিয়েছেছবি: সংগৃহীত
ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে ২৫ দিনের মতো খাবার রয়েছে। এ ছাড়া জাহাজটিতে বিশুদ্ধ পানি রয়েছে ২০০ টন।
জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিকউল্লাহ খান এক অডিও বার্তায় এ তথ্য জানিয়েছেন জাহাজটির মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের কর্মকর্তাদের কাছে। জাহাজটি জলদস্যু নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর গতকাল মঙ্গলবার এই বার্তা পাঠানো হয়।
আতিকউল্লাহ খান অডিও বার্তায় বলেন, ‘আমাদের জাহাজে ২০–২৫ দিনের রসদ (খাবার) আছে। ২০০ টন বিশুদ্ধ পানি আছে। আর জাহাজে রয়েছে ৫৫ হাজার টন কয়লা।’ রসদ যাতে দ্রুত ফুরিয়ে না যায়, সে জন্য অপ্রয়োজনে ব্যবহার না করার জন্য সবাইকে জানানো হয়েছে।
মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টায় জাহাজটিতে উঠে নিয়ন্ত্রণ নেয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জাহাজটিতে ৫৫ হাজার টন কয়লা রয়েছে। জাহাজটিতে থাকা ২৩ জন নাবিকের সবাই বাংলাদেশি। জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং লিমিটেডের মালিকানাধীন।
জাহাজটির মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাহাজটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া কবির গ্রুপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এখনো জলদস্যুরা যোগাযোগ করেনি। এ হিসেবে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই খাবার দিয়ে চলতে হবে জাহাজের নাবিক ও দস্যুদের।
যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন (ইউকে এমটিও) তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল পূর্বে এ ঘটনা ঘটেছে। দুটি নৌযানে (একটি বড় এবং আরেকটি ছোট) চড়ে জাহাজটির কাছাকাছি এসে জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ইউকে এমটিও সমুদ্র চলাচলকারী অন্য জাহাজগুলোতে সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করতে বলেছে।
জাহাজের কর্মকর্তারা কবির গ্রুপে পাঠানো নানা বার্তায় জানিয়েছেন, জাহাজটি এখন সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দস্যুরা।
কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে প্রথমে নাবিকদের সুরক্ষার বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। জলদস্যুরা নাবিকদের কোনো ক্ষতি করেনি। তাঁরা সুস্থ আছে। জাহাজে নাবিকদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
জাহাজে নাবিকদের খাবার ফুরিয়ে গেলে কীভাবে সামাল দেওয়া হয়, জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর এখন রেশনিং করে চলতে হবে। ২০০ টন পানি দিয়ে সাধারণত এক মাস চলা যায়। রেশনিং করলে আরও বেশি দিন যাবে। একইভাবে ২৫ দিনের খাবার রেশনিং করে আরও কিছুদিন চালিয়ে নেওয়া যাবে। তবে জ্বালানি নিয়ে খুব সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, যত দ্রুত জাহাজ ও নাবিকদের ছাড়িয়ে আনা যাবে, তাহলে খাবার–জ্বালানি নিয়ে সমস্যা হবে না। আবার জলদস্যুরা উপকূলের কাছাকাছি নেওয়ার পর প্রয়োজনে খাবার–পানির ব্যবস্থা করে।
এর আগে ২০১০ সালে একই গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি জাহান মণি ছিনতাই হওয়ার তিন মাস পর মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছিল গ্রুপটি। আবার কোনো জাহাজ ছয় থেকে আট মাস পর মুক্ত হওয়ার নজির রয়েছে।
সূত্র : প্রথম আলো