search the site
চীনকে ঠেকাতে ভারত-জাপানের যৌথ পরিকল্পনার ফসল মাতারবাড়ি
চীনকে ঠেকাতে ভারত-জাপানের যৌথ পরিকল্পনার ফসল মাতারবাড়ি
চীনকে ঠেকাতে ভারত-জাপানের যৌথ পরিকল্পনার ফসল মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। এমনটাই বলা হয়েছে টোকিওভিত্তিক গণমাধ্যম নিকেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনমতে, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নির্মাণাধীন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর জাপান ও ভারতের জন্য একটি কৌশলগত ‘নোঙর’ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে যখন সামরিক জোট কোয়াডের দুই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেশদুটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনা প্রভাব মোকাবিলা করতে চাইছে।

জাপানের অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় সোনাদিয়ার (কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে) ঠিক উত্তরে গড়ে উঠছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর। ছবি: সংগৃহীত
somoynews.tv 18 November 2023
বিশ্বজুড়ে চীনের প্রভাব মোকাবিলার একটি চেষ্টা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে কোয়াড সামরিক জোট। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বাইরে চার জাতির এ জোটের অন্য দুই দেশ জাপান ও ভারত। দেশদুটির চীনবিরোধী লড়াইয়ে ভূরাজনৈতিক কৌশলের একটি অপরিহার্য অংশ হতে যাচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর।
জাপানের অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় সোনাদিয়ার (কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে) ঠিক উত্তরে গড়ে উঠছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। সোনাদিয়া হলো বঙ্গোপসাগরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেখানে চীন একটি বন্দর গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। যদিও সেই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। জানা যায়, ঢাকা কয়েক বছর আগে ওই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের যে লড়াই চলছে, চীনা অর্থায়নে বন্দর প্রকল্প থেকে ঢাকার সরে আসার সিদ্ধান্তকে তখন অনেক বিশ্লেষক ভারতের জন্য কৌশলগত বিজয় হিসেবে ঘোষণা করেন। এ ক্ষেত্রে ভারতের বন্ধু জাপানকেও বিজয়ী বলে বিবেচনা করা হয়। যদিও কেউ কেউ এখানে আদৌ কোনো গেম বা শক্তির লড়াই দেখছেন না।
আরও পড়ুন: মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেল উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মাতারবাড়ী যে ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায় চলতি বছরের মার্চে জাপানি প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার ভারত সফরের সময়। তার খোলামেলা ইন্দো-প্যাসিফিক এজেন্ডার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে চলে আসে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর।
মার্চেই জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ১৬ হাজার ৫০০ কোটি ইয়েন (১২০ কোটি ডলার) ঋণ দেয়ার কথা ঘোষণা করে। যার আগেই আরও ৩ হাজার ৮৮০ কোটি ইয়েন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল টোকিও।
ভারত সফরের সময় দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী কিশিদা বলেন, জাপান দক্ষিণ এশীয় দেশদুটির মধ্যে সহযোগিতার অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকা পর্যন্ত একটি শিল্প অবকাঠামো গড়ে তুলবে, যার লক্ষ্য হবে ‘পুরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো’।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরে থাকবে একটি কনটেইনার টার্মিনাল ও একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বন্দর এলাকা খনন করে গভীর করা হবে, যাতে সেখানে বড় কনটেইনার জাহাজ কিংবা ট্যাংকার ভিড়তে পারে। যার ফলে লোহার আকরিক আমদানি করা বা বড় পরিমাণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি সহজ হবে।
আরও পড়ুন: দৃশ্যমান অগ্রগতি হাতে নিয়ে মাতারবাড়ি যাবেন প্রধানমন্ত্রী
প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন, জাইকার এমন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পানির গভীরতার দিক দিয়ে মাতারবাড়ি হবে শ্রীলঙ্কার কলম্বো কিংবা সিঙ্গাপুর বন্দরের সমতুল্য।’ ২০২৭ সালে বন্দর নির্মাণকাজ শেষ হলে মাতারবাড়ি হবে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, যা চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাবে।
এ ছাড়া এটি ভারতের অনুন্নত উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য একটি প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে কাজ করবে। চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ভূমি দিয়ে বেষ্টিত ভারতের এ রাজ্যগুলো ‘সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত।
মাতারবাড়ি যে কেবল এই সেভেন সিস্টার্সের জন্যই সবচেয়ে সুবিধাজনক বন্দর হবে তা-ই নয়, এটি তাদের জন্য সবচেয়ে বিচক্ষণ বিকল্পও হয়ে উঠবে। কেননা, এ মুহূর্তে প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গেই ভারতের সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
হিমালয় অঞ্চলে চীনের সঙ্গে ভারতের একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে দেশদুটির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা লক্ষণীয়। এদিকে মিয়ানমারে সামরিক শাসন চলছে। যেখানে নাগরিকরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে জাপান, ভারত ও বাংলাদেশি কর্মকর্তা এরই মধ্যে তাদের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আরও পড়ুন: ‘জাপানকে দিয়ে মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের কৌশল কূটনৈতিক বিজয়’
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ফেয়ারব্যাঙ্ক সেন্টার ফর চাইনিজ স্টাডিজের গবেষণা সহযোগী আনু আনোয়ার সম্প্রতি নিকেই এশিয়াকে বলেন, চীনের সঙ্গে সোনাদিয়া বন্দর গড়ে তোলার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি, ‘কারণ, এ ব্যাপারে ভারতের আপত্তি ছিল, যা দিল্লির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে ঢাকা নাকচ করতে পারেনি।’
তবে আনু আনোয়ার একই সঙ্গে বলেন, ভারত চীনা প্রস্তাবের বিকল্পও কিছু দিতে পারেনি। কারণ, তাদের সেই সম্পদ ছিল না। সুতরাং তারা মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণে জাপানকে স্বাগত জানায়। এ বন্দর বাংলাদেশের স্বার্থ যতটা রক্ষা করবে, ভারতের স্বার্থ তার চেয়ে কম রক্ষা করবে বলে মনে হয় না।’
জাপানের মেইকাই ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তেতসুও কোতানি টোকিওর পরিকল্পনার বিশ্লেষণ করেন এভাবে, ‘মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাপানে যে তেল রফতানি হয়, তা আসে বঙ্গোপসাগর হয়ে। ফলে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রজায় রাখার লক্ষ্য নিয়ে জাপান এখানে বিনিয়োগ করছে।’
তিনি আরও বলেন, এ অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ করার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে জাপান ভবিষ্যতে সামরিক সহযোগিতা শুরুর জন্য ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে।
তার কথায়, ‘যে কোনো সামরিক সহযোগিতা শুরু হয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও মানুষের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে।’ চলতি বছরের এপ্রিলেই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী একটা সামরিক মহড়া করে যার পর্যবেক্ষক ছিল জাপান।
আরও পড়ুন: ‘মাতারবাড়ি হবে দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুর’
জাইকার কর্মকর্তা বলেন, গত দশকে জাপান বাংলাদেশের জন্য আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বেশ বাড়িয়েছে। প্রতিবছর জাপান ইয়েনে যত ঋণ দেয়, বাংলাদেশ তার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পায়। বেশির ভাগ অর্থ খরচ হয় সড়ক, সেতু ও অন্যান্য বেসামরিক অবকাঠামো তৈরিতে।
বন্দর উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাপান মাতারবাড়ির চেয়ে ভালো আর কোনো স্থানের কথা ভাবতেও পারত না। কারণ, এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি প্রাকৃতিক প্রবেশদ্বার।
যেমনটা বলছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তার ভাষ্য: ‘রিয়েল এস্টেট বা আবাসন খাতের মতোই ভূরাজনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে স্থান, স্থান ও স্থানই হলো সবকিছু। মাতারবাড়ি সেই উদ্দেশ্য পূরণ করে।’
মাইকেল কুগেলম্যান আরও বলেন, দীর্ঘদিনের সাহায্যকারী হিসেবে জাপান মাতারবাড়ির কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আর সে কারণে পাঁচ বছর আগে বন্দরটি উন্নয়নে তারা অঙ্গীকার করে। মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ একটি ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ রূপ নিয়েছে।
আরও পড়ুন: মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, অর্থনীতির লাইফলাইন
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘মোদি সরকার ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করলেও অবকাঠামোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন বাংলাদেশে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে। ঢাকা যাতে বেইজিংয়ের ওপর বাণিজ্যিক নির্ভরতা কমায়, সে জন্য ওয়াশিংটনও সম্পর্ক জোরদার করতে চায়।’
তিনি ধারণা দেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি এদের কাছে ঢাকাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বাংলাদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর মোংলার উন্নয়নে এখন চীন ও ভারত এই দুই দেশই তহবিল জোগানোর সুযোগ খুঁজছে।
ফেয়ারব্যাঙ্ক সেন্টারের আনু আনোয়ার মনে করেন, বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলতে চীন ও জাপানের আগ্রহ বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের কথাই তুলে ধরে।
তবে তিনি বলেন, ‘যদিও প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরটি গড়ে তুলতে বাংলাদেশ চীনাদের চেয়ে জাপানি বিনিয়োগ পছন্দ করেছে, তার মানে এই নয় যে দেশটি বন্দরটিকে একটি ভূরাজনৈতিক গুটি হতে দেবে, যাকে এক শক্তি অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে।’
আরও পড়ুন: মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর
তবে ‘বিশাল দেশগুলো বাংলাদেশের বন্দর নিয়ে যুদ্ধে মেতেছে’—এমন ধারণা বাতিল করে দেন ঢাকাভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক অ্যাডাম পিটম্যান। বিষয়টিকে হাস্যকর হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ সংগ্রহ করছে, সেটিই এখানে দেখা যাচ্ছে।
অ্যাডাম পিটম্যান যুক্তি দেন, চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে বাস্তব কোনো আগ্রহ প্রকাশ করার অনেক আগে থেকেই জাপান দেশটিতে বিনিয়োগ করে আসছে। ‘সেই দীর্ঘমেয়াদি অঙ্গীকারের প্রেক্ষাপটেই মাতারবাড়ি বন্দরের বিষয়টি দেখা উচিত,’ যোগ করেন তিনি।
অ্যাডাম পিটম্যান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কিশিদার খোলামেলা ইন্দো-প্যাসিফিকের ধারণা হয়তো সেই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নতুন উদ্দীপনা জোগাতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি না যে এটা এখানে জাপানের দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত গতিপথকে কোনোভাবে পরিবর্তন করবে।’