দিনের আলোয় ওই চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা;

Comments Off on দিনের আলোয় ওই চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা;

দিনের আলোয় ওই চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা;

পথে-ঘাটে ট্রাক ট্রামলাইনে ফুটপাতে;

কোথাও পরের বাড়ি এখুনি নিলেম হবে— মনে হয়,

জলের মতন দামে।

সকলকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে পৌঁছুবে

সকলের আগে সকলেই তাই।

অনেকেরই ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হয়, তবু

নিলেমের ঘরবাড়ি আসবাব— অথবা যা নিলেমের নয়

সে-সব জিনিস

বহুকে বঞ্চিত ক’রে দু’-জন কি একজন কিনে নিতে পারে।

পৃথিবীতে সুদ খাটে : সকলের জন্যে নয়।

অনির্বচনীয় হুণ্ডি একজন দু’-জনের হাতে।

পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকেদের দাবি এসে

সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।

বাকি সব মানুষেরা অন্ধকারে হেমন্তের অবিরল পাতার মতন

কোথাও নদীর পানে উড়ে যেতে চায়,

অথবা মাটির দিকে— পৃথিবীর কোনও পুনঃপ্রবাহের বীজের ভিতরে

মিশে গিয়ে। পৃথিবীতে ঢের জন্ম নষ্ট হ’য়ে গেছে জেনে, তবু

আবার সূর্যের গন্ধে ফিরে এসে ধুলো ঘাস কুসুমের অমৃতত্বে কবে

পরিচিত জল, আলো, আধো অধিকারিণীকে অধিকার ক’রে নিতে হবে :

ভেবে তারা অন্ধকারে লীন হ’য়ে যায়।

লীন হ’য়ে গেলে তারা তখন তো— মৃত।

মৃতেরা এ-পৃথিবীতে ফেরে না কখনও।

মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?

কোনও-কোনও অঘ্রাণের পথে পায়চারি-করা শান্ত মানুষের

হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই ব’লে মনে হয়;

তা হ’লে মৃত্যুর আগে আলো অন্ন আকাশ নারীকে

কিছুটা সুস্থিরভাবে পেলে ভালো হ’তো।

বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল।

সূর্য অস্তে চ’লে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার

খোঁপা বেঁধে নিতে অাসে— কিন্তু কার হাতে?

আলুলায়িত হ’য়ে চেয়ে থাকে— কিন্তু কার তরে?

হাত নেই— কোথাও মানুষ নেই; বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন

আলপনার, পটের ছবির মতো সুহাস্যা, পটলচেরা চোখের মানুষী

হ’তে পেরেছিল প্রায়; নিভে গেছে সব।

এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে;

নতুন চালের রসে রৌদ্রে কত কাক

এ-পাড়ার বড়ো মেজো… ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের

ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত;

এখন টুঁ শব্দ নেই সেই সব কাকপাখিদেরও;

মানুষের হাড় খুলি মানুষের গণনার সংখ্যাধীন নয়;

সময়ের হাতে অন্তহীন।

ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হ’তো

ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে মাঝি বাগ্‌দির

ঈশ্বরী মেয়ের সাথে

বিবাহের কিছু আগে— বিবাহের কিছু পরে— সন্তানের জন্মাবার আগে।

সে-সব সন্তান আজ এ-যুগের কুরাষ্ট্রের মূঢ়

ক্লান্ত লোকসমাজের ভিড়ে চাপা প’ড়ে

মৃতপ্রায়; আজকের এই সব গ্রাম্য সন্ততির

প্রপিতামহের দল হেসে খেলে ভালোবেসে— অন্ধকারে জমিদারদের

চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে চড়কের গাছে তুলে ঘুমায়ে গিয়েছে।

ওরা খুব বেশি ভালো ছিল না; তবুও

আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরক্ষরতায়

অন্ধ শতছিন্ন গ্রাম্য প্রাণীদের চেয়ে

পৃথক আর-এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিল।

অাজকে অস্পষ্ট সব? ভালো ক’রে কথা ভাবা এখন কঠিন;

অন্ধকারে অর্ধসত্য সকলকে জানিয়ে দেবার

নিয়ম এখন আছে; তারপর একা অন্ধকারে

বাকি সত্য আঁচ ক’রে নেওয়ার রেওয়াজ

র’য়ে গেছে; সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে।

সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়— দ্বেষ।

সৃষ্টির মনের কথা : আমাদেরই আন্তরিকতাতে

অামাদেরই সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা

খুঁজে আনা। প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল

ঝর্ণার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে

দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল

হ’য়ে আছে ব’লে বাঘ হরিণের পিছু আজও ধায়;

মানুষ মেরেছি আমি— তার রক্তে আমার শরীর

ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার

ভাই অামি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু

হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ ক’রে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর

কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে

বধ ক’রে ঘুমাতেছি— তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে

মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী

সকলকে অালো দেবে মনে ক’রে অগ্রসর হ’য়ে

তবুও কোথাও কোনও অালো নেই ব’লে ঘুমাতেছে।

ঘুমাতেছে।

যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে

ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,

হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ—

আর তুমি?’ আমার বুকের ’পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে

চোখ তুলে সুধাবে সে— রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে

বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;

মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালীর—’

কোথাকার কে-বা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর

মানুষ তো এরা সব; ছেঁড়া জুতো পায়ে

বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে;

সৃষ্টির অপরিক্লান্ত চারণার বেগে

এই সব প্রাণকণা জেগেছিল— বিকেলের সূর্যের রশ্মিতে

সহসা সুন্দর ব’লে মনে হয়েছিল কোনও উজ্জ্বল চোখের

মনীষী লোকের কাছে এই সব অণুর মতন

উদ্ভাসিত পৃথিবীর উপেক্ষিত জীবনগুলোকে।

সূর্যের আলোর ঢলে রোমাঞ্চিত রেণুর শরীরে

রেণুর সংঘর্ষে যেই শব্দ জেগে ওঠে

সেখানে সময় তার অনুপম কণ্ঠের সংগীতে

কথা বলে; কাকে বলে? ইয়াসিন মকবুল শশী

সহসা নিকটে এসে কোনও-কিছু বলবার আগে

আধ-খণ্ড অনন্তের অন্তরের থেকে যেন ঢের

কথা ব’লে গিয়েছিল; তবু—

অনন্ত তো খণ্ড নয়; তাই সেই স্বপ্ন, কাজ, কথা

অখণ্ড অনন্তে অন্তৰ্হিত হ’য়ে গেছে;

কেউ নেই, কিছু নেই— সূর্য নিভে গেছে।

এ-যুগে এখন ঢের কম আলো সব দিকে, তবে।

আমরা এ-পৃথিবীর বহুদিনকার

কথা কাজ ব্যথা ভুল সংকল্প চিন্তার

মর্যাদায় গড়া কাহিনীর মূল্য নিংড়ে এখন

সঞ্চয় করেছি বাক্য শব্দ ভাষা অনুপম বাচনের রীতি।

মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো

না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল

জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে।

অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু

অামাদের এই শতকের

বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু— বেড়ে যায় শুধু;

তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই ব’লে অর্থময়

জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।

এ-যুগে কোথাও কোনও আলো— কোনও কান্তিময় আলো

চোখের সুমুখে নেই যাত্রিকের; নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার

রাত্রির মায়ের মতো : মানুষের বিহ্বল দেহের

সব দোষ প্রক্ষালিত ক’রে দেয়— মানুষের বিহ্বল আত্মাকে

লোকসমাগমহীন একান্তের অন্ধকারে অন্তঃশীল ক’রে

তাকে আর শুধায় না— অতীতের শুধানো প্রশ্নের

উত্তর চায় না আর— শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন

অন্ধকারে ঘিরে রাখে, সব অপরাধ ক্লান্তি ভয় ভুল পাপ

বীতকাম হয় যাতে— এ-জীবন ধীরে-ধীরে বীতশোক হয়,

স্নিগ্ধতা হৃদয়ে জাগে; যেন দিকচিহ্নময় সমুদ্রের পারে

কয়েকটি দেবদারুগাছের ভিতরে অবলীন

বাতাসের প্রিয়কণ্ঠ কাছে আসে— মানুষের রক্তাক্ত আত্মায়

সে-হাওয়া অনবচ্ছিন্ন সুগমের— মানুষের জীবন নির্মল।

আজ এই পৃথিবীতে এমন মহানুভব ব্যাপ্ত অন্ধকার

নেই আর? সুবাতাস গভীরতা পবিত্রতা নেই?

তবুও মানুষ অন্ধ দুর্দশার থেকে স্নিগ্ধ আঁধারের দিকে

অন্ধকার হ’তে তার নবীন নগরী গ্রাম উৎসবের পানে

যে অনবনমনে চলেছে আজও— তার হৃদয়ের

ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম ক’রে চেতনার

বলয়ের নিজ গুণ র’য়ে গেছে ব’লে মনে হয়।

কবি: জীবনানন্দ দাশ

কবিতা: ১৯৪৬-৪৭

কাব্যগ্রন্থ: শ্রেষ্ঠ কবিতা

কাব্য নং: ০১৯১

Comments are closed.