search the site
এক তরুণের অপমৃত্যু এবং বাংলার সমৃদ্ধি
এক তরুণের অপমৃত্যু এবং বাংলার সমৃদ্ধি
ক্যাপ্টেন মাহমুদ
০৫ মার্চ ২০২২ | অনলাইন সংস্করণ
জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধি।
লেখাটি যখন লিখছি, তখন টিভির পর্দায় ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছিল, ‘বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের ২৮ জন নাবিককে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ।’
কিন্তু তারা এ ধন্যবাদটি পেতে একটি সম্ভাবনাময় যুবককে কোরবানি দিলেন।
মূল বিষয় নিয়ে কিছু বলার আগে পুরনো একটি ঘটনার কথা উদাহরণ হিসেবে টানতে চাই।
সময়: ১৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা
স্থান: গ্যালেভেস্টন, গাল্ফ অফ মেক্সিকো
হারিকেন বেটা এগিয়ে আসছে আমেরিকান উপকূলের দিকে, স্থলভাগ অতিক্রম করবে আমাদের ১৫০ কিমি পূর্বে, সাবিন চ্যানেলের কাছ দিয়ে, হয়ত সন্ধ্যার দিকে। ঝড়ের কেন্দ্র আমাদের থেকে প্রায় ৩০০ কিমি দূরে। রাতে আবহাওয়ার যে পূর্বাভাস পেয়েছিলাম, তাতে মনে হয়েছিল দুপুর বারটার দিকে নোঙর তোলার সিদ্ধান্ত নেব।
আবহাওয়া নিয়ে অবচেতন মনের দুশ্চিন্তা থেকে সকাল সাতটায় ঘুম ভেঙে গেল। ব্রিজে গিয়ে দেখলাম বাতাসের বেগ বেশ বেড়ে গেছে, ৫০ কিমি এর কাছাকাছি। আধাঘন্টা দাড়িয়ে দাড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করে স্বস্তি পেলাম না। নির্দেশ দিলাম ইঞ্জিন প্রস্তুত করার জন্য, নোঙর তুলতে হবে। বাতাসের গতি আরও বেড়ে গেলে নোঙর তোলাই কঠিন হয়ে যাবে।
সকাল আটটায় ইঞ্জিন প্রস্তুত। কিন্তু ভাড়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ একটি জাহাজকে নোঙর তুলে চলে যেতে হলে বাণিজ্যিক বিভাগের অনুমতি নিতে হবে, কারণ চার্টারার, যে জাহাজ ভাড়া করেছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে কমার্শিয়াল বিভাগের। জাহাজ বন্দরের এংকরেজে, জাহাজ ভাড়া হয়ে গেছে, কার্গোর জন্য জেটিতে ভেড়ার অপেক্ষায়।
নোঙর করার আগে আমরা ‘নোটিশ অব রেডিনেস’ পাঠিয়ে দিয়েছি, তখন থেকেই আমাদের ভাড়া শুরু হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে নোঙর থেকে জাহাজ চলে গেলে আইনত আমরা চুক্তি লংঘন করছি। বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের জেটিতে ভেড়ার জন্য যে সিরিয়াল তৈরি করেছে, সেখান থেকেও বাদ পরে যাব। এতে কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মূখীন হতে হবে তা আমি জানি না, অংকটা কোন কত সেটা কোন ক্যাপটেনেরই জানা থাকে না, থাকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখানে বসে থাকলে জাহাজের নাবিক এবং জাহাজের নিরাপত্তা ব্যহত হতে পারে, সে হিসেবটুকু শুধু আমার আছে, এবং সেটাই আমার কাছে মূখ্য।
নোঙর তোলার আগে কমার্শিয়াল বিভাগের ম্যানেজারকে ফোন করলাম। সে ফোন ধরল না, অনুমান করছি সে গাড়ি চালাচ্ছে। কী করব ভেবে সময় নষ্ট করলাম না, গ্যলভেস্টন পোর্ট কনট্রোলকে রেডিওতে জানালাম আবহাওয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি নোঙরে থাকা নিরাপদ মনে করছি না, তাই নোঙর তুলে গভীর সমূদ্রে যাব। ওরা আমাদের আটকে রাখার কেউ না, শুধু জেটিতে ভেড়ার লাইন থেকে হয়তবা আমাদের নাম সরিয়ে দেবে, বড়জোর এটাই হবে। দেরি না করে নোঙর তুলে রওনা দিলাম সমূদ্রে দিকে। আধা ঘন্টার মধ্যেই ফিরতি কল পেলাম কমার্শিয়াল ম্যানেজার এর কাছ থেকে, জানতে চাইলেন কি ব্যপারে কল দিয়েছিলাম। বললাম আমি নোঙর তুলে রওনা হয়েছি, আবহাওয়া পরিস্থিতি এঙ্করেজে থাকার মত নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
ওকে ক্যাপটেন, আমাকে একটা মেইল করে দাও, সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠ সবাইকে জানিয়ে দাও।
সন্ধ্যার দিকে ঝড় লুসিয়ানা আর টেক্সাসের সীমান্তবর্তী সাবিন এর দিকে উপকূল অতিক্রম করছিল, আমরা তখন ৩০০ কিমি দূরে। ইলেকট্রনিক চার্টে সে এলাকার কাছাকাছি আরেকটি জাহাজের AIS (Automatic Identification System) অবস্থান দেখাচ্ছিল। সে জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমার সিনিয়র, রিয়াসাত হোসেন চৌধুরী। স্যারকে মেসেজ করে জানতে চাইলাম, আপনারা এখনও সেখানে কেন? আপনারা তো হারিকনের প্রায় মুখোমুখী।
সে অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলল, কী করব বলো, সকাল থেকে কেউ ডিসিশন দিতে পারছে না।
⁃ কে ডিসিসন দেবে? কার ডিসিশনের জন্য জাহাজ অপেক্ষায় ছিল?
আর বলোনা, সকালে হিউস্টনে টেকনিকেল সুপারিনটেন্ডেন্ট এর সঙ্গে কথা হয়েছিল, সে বলছে এ ব্যপারে সে ডিসিশন দিতে পারবে না, সেফটি ডিপার্টমেন্টের অনুমতি লাগবে। হিউস্টনে সেফটি ডিপার্টমেন্টের খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ কাজ করে, আসল কার্যক্রম চালানো হয় সিঙ্গাপুর থেকে, যেখানে তখন গভীর রাত। হিউস্টন অফিস সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি তাই অপেক্ষায় ছিল সিঙ্গাপুর থেকে কোন উত্তর পাবার। এভাবে কালক্ষেপণ হয়েছে। শেষ মুহূর্তে ঝড় যখন একদম দোরগোড়ায়, তখন কেউ বাধ্য হয়ে অনুমতি দিয়েছে নোঙর তোলার।
ভাগ্য ভাল সেদিনের হারিকেন ‘বেটা’ উপকূলের কাছে এসি কিছুটা শক্তি হারিয়েছিল, জাহাজটি বেশ ভাল ছিল, তাই চরম কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু ৯০% আশঙ্কা ছিল এমন পরিস্থিতিতে কোন দুর্ঘটনা ঘটার। যদি ঘটত, এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী হতো জাহাজের ক্যাপ্টেন, কারণ তার জানা উচিৎ নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় যে কোন পদক্ষেপ নেবার আইনানুগ ক্ষমতা তার রয়েছে।
জাহাজ পরিচালনায় প্রধানত তিনটি বিভাগ কাজ করে। টেকনিক্যাল, সেফটি বা কোয়ালিটি এবং কমার্শিয়াল অপারেশন।
টেকনিক্যাল বিভাগ জাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ, সাপ্লাই, মেরামত সব কিছু দেখাশুনা করে। জাহাজ পরিচালনার মূল বাজেট থাকে তাদের কাছে সুতরাং বলা চলে তারাই মূল নিয়ন্ত্রক। জাহাজের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ টেকনিক্যাল বিভাগের। সেফটি বা কোয়ালিটি বিভাগ নিশ্চিত করে যে জাহাজ মানসম্মত এবং নিরাপদে পরিচালিত হচ্ছে। যদি ট্যাকনিক্যাল বিভাগ পয়সা বাঁচানোর জন্য জাহাজে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ না করে, সেফটি বিভাগ তখন তাদের শাসন করে এবং নিশ্চিত করে জাহাজ যাতে মানসম্মত ভাবে চালানো হয়। সেফটি ও টেকনিক্যাল বিভাগ যৌথভাবে নিশ্চিত করে জাহাজ যাতে সব সময় নিরাপদে সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী থাকে।
আর কমার্শিয়াল অপারেশন হল জাহাজের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে, খদ্দের যোগার করে, ভাড়া দেয় ভাড়া নেয়। জাহাজের কি সমস্যা আছে, কি কাজ করছে না, এসব তারা দেখতে চায়না। তারা চায় সব সময় জাহাজ নিঃখুত থাকবে, সমস্যাহীন থাকবে। যদি না থাকে, তারা টেকনিক্যাল ও সেফটি বিভাগের কাছে জবাবদিহি চাইবে, কেন জাহাজের এ সমস্যা, কেন আগে এসব মেরামত করা হয় নি। যেহেতু কমার্শিয়াল বিভাগ জাহাজের উপার্জন নিশ্চিত করে, তারাই জাহাজ পরিচালনা সংশ্লিষ্ঠ বিভাগগুলির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাবান। জাহাজ কোথায় থাকবে, নোঙরে থাকবে না ভাসবে, কত স্পীড করবে, পূবে যাবে না পশ্চিমে, সব কিছু ঘটবে কমার্শিয়াল এর নির্দেশে, তারাই সব দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। উপরোক্ত উদাহরন এবং জাহাজ পরিচালনার কাঠামো সমন্ধে লিখার উদ্দেশ্য হলো বাংলার সমৃদ্ধিতে কি ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, তা সবার জন্য সহজবোধ্য করা।
এবার বাংলার সমৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আসা যাক। কি ঘটেছিল সেই প্রথম থেকে?
আসলে কি হয়েছিল,কি কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা জানবে এক মাত্র জাহাজের ক্যাপটেন এবং বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন। আসল এবং সত্যি ঘটনা কেউ বলবে না সেটা নিশ্চিত। কিন্তু একজন সমূদ্রগামী জাহাজের ক্যাপটেন হিসেবে সম্ভাব্য কি কি ঘটতে পারে, তা কিছুটা হলেও অনুমান করা সম্ভব।
২২ শে ফেব্রুয়ারি: বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটি পোর্ট অলভিয়া পৌঁছে।
এখানে উল্লেখ্য ১৫ ফেব্রুয়ারি “The Joint War Committee, the marine insurance advisory board” ব্ল্যক সি এর ইউক্রেইন এবং রাশিয়া নিকটবর্তি এলাকাকে ওয়ার রিস্ক জোনে অন্তর্ভূক্ত করে।
পোর্ট অলভিয়ার অবস্থান ইউক্রেইন উপকূলের একদম পূর্ব দিকে, ক্রিমিয়ার কাছাকাছি, সুতরাং ধরে নেয়া যায় সেটা ছিল সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ এলাকা, কারন রাশিয়ার আক্রমন সেদিক দিয়েই শুরু হবার সম্ভাবনা। জাহাজটি গিয়ে জেটিতে ভিড়ে নি, নোঙরে অপেক্ষমান ছিল। সুতরাং এমন পরিস্থিতে জাহাজটি ইচ্ছে করলে বন্দর এলাকায় প্রবেশ না করে বহিঃসমূদ্রে ভাসমান থাকতে পারত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য।
২৩ শে ফেব্রুয়ারি: জাহাজটি নোঙর করার পরের দিন রাশিয়া ইউক্রেইন আক্রমন করে। এরকম পরিস্থিতিতে শুধু মাত্র জীবনের নিরাপত্তার জন্যই যে কোন জাহাজ বন্দর ত্যাগ করে বাইরে চলে যাওয়া উচিৎ।
এখন প্রশ্ন জাগে, ক্যাপটেন কি বন্দর ত্যাগ করার অনুমতি চেয়েছিল?
যদি উনি না চেয়ে থাকেন, শিপিং কর্পোরেশন থেকে কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কিংবা ক্যাপটেন কে বলা হয়েছিল বন্দর ত্যাগ করার জন্য?
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত শিপিং কর্পোরেশনের বক্তব্যে জানা যায়, জাহাজটিকে সাগর যেতে হলে ৭০ নটিক্যাল মাইল চ্যানেল পাড়ি দিতে হবে, যার জন্য পাইলট প্রয়োজন।
কিন্তু পোর্ট অলভিয়া বন্দর দপ্রভস্কা উপসাগর থেকে মাত্র ১১ নটিকেল মাইল ভেতরে। মেরিন ট্রাফিক “বাংলার সমৃদ্ধি” জাহাজের যে অবস্থান দেখাচ্ছে সেখান থেকে উপ সাগর ১০ মাইল, সেখান থেকে আরও মাইল পনের গেলেই উপসাগর থেকে বের হয়ে উন্মুক্ত ব্ল্যাক সি তে পৌঁছবে।
বিএসসি মুখপত্র আরও বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতির কারনে পাইলট পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
খুবই সম্ভব যে এরকম পরিস্থিতিতে বন্দরের কার্যকলাপ অচল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো জাহাজের ক্যাপটেন কি নিজে নোঙর তুলে চলে যাবার জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন বা বিনা পাইলটে নিজ থেকে চলে যাবার কোন উদ্যোগ কি তিনি নিয়েছিলেন?
বন্দর কর্তৃপক্ষ কি তাকে বাধা দিয়েছিল বিনা পাইলটে চলে যেতে?
যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য যেখানে পাইলট দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা, সেখানে কেউ বাঁধা দেবার মত ছিল বলেও মনে হয় না।
পোর্ট অলভিয়া মূলত বেশ প্রসস্থ একটি খাড়ির মধ্যে, সাগর থেকে মাত্র ১১ মাইল ভেতরে। খাড়ির প্রস্থ ৩ মাইলের মত, সবচেয়ে সংকীর্ণ জায়গাটিতে ২ মাইল। বাংলার সমৃদ্ধি ৩৯ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন , দৈর্ঘ্য ১৮০ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ মিটার এবং জাহাজটির বর্তমান ড্রাফ্ট বা গভীরতা মাত্র ৬.৫ মিটার। চ্যানেলে বাতাস এবং স্রোত খুবই সহনীয় পর্যায়ের, উদভূত পরিস্থিতিতে বিনা পাইলটে এমন একটি ছোট জাহাজ নিয়ে বের হয়ে আসা কঠিন কিছু নয়।
যুদ্ধ শুরু হবার পরপরই জাহাজটি বের হয়ে না আসার কারণ হিসেবে বিভিন্ন জটিলতার কথা বলে হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, রাশিয়া যখন নদীর এক পারে চলে এসেছে, তখন কিন্তু ২৮ জন নাবিক নামিয়ে আনতে বা তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ২৮ জন লোক নামিয়ে আনা, এ রকম পরিস্থিতিতে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করা, একটি জাহাজকে জনমানবশূন্য এবং ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় নোঙরে এবানডন করে রেখে আসা, সমস্ত কিছু করার জন্য প্রচুর কূটনৈতিক প্রক্রিয়া এবং প্রচেষ্টার প্রয়োজন, যা খুব অল্প সময়ে করা হয়েছে। কিন্তু একটি জাহাজকে পাইলট ছাড়া চালিয়ে বাইরে নিয়ে আসার জন্য মনে হয় না ম্যানেজমেন্ট তেমন কোনও প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।
এক সময় জাহাজ ছিল সম্পূর্ণ ক্যাপটেন বা মাস্টার নির্ভর। এখন জাহাজ অপারেশনের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রিত হয় শোর-অফিস বা ম্যনেজমেন্ট থেকে।
জাহাজে কী করতে হবে, কোথায় নিরাপত্তার হুমকি রয়েছে, কোথায় নতুন কি আইন এসেছে, প্রতিদিন এর আপডেট জাহাজে পাঠানো হয় অফিস থেকে। আগে যে সকল ফর্মালিটিস ক্যাপটেনকে করতে হতো, তার অনেক কিছুই এখন অফিস থেকে করে দেয়া হয়। ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি যত এফিসিয়েন্ট, ব্যবসা ততো লাভজনক। একটি জাহাজ ভাড়া নেবার আগে প্রথমেই দেখা হয় তাদের ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কোন মানের। জাহাজ কোম্পানিতে জাহাজের সংখ্যা কম হলে তারা ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ভাড়া করে তাদের জাহাজ চালনার জন্য কারন ৮-১০ টি জাহাজ চালানোর জন্য একটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি চালানো ব্যয়বহুল হয়ে যায়। কিন্তু বড় বড় কোম্পানী, যেমন শেল, বিপি, মায়েরকস লাইন, এনওয়াইকে, এদের জাহাজের সংখ্যা শ দেড়শ, এরা নিজেরাই নিজেদের জাহাজ ম্যানেজ করে। এদের বলা হয় ঔনারশীপ ম্যানেজমেন্ট। আবার ভি-শিপ, বার্নার্ড শুলটে, এংলো ইস্টার্ন, এরা বড় ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, এরা একেকজন ৫০০ শিপ ম্যানেজ করে। কিন্তু তাদের নিজস্ব কোন জাহাজ নেই। যে সব মালিকদের হয় পাচটা দশটা জাহাজ আছে, তারা তাদের জাহাজ পরিচালনার জন্য এদের কাছে দিয়ে দিয়েছে পারিশ্রমিক বা সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে।
জাহাজের সংখ্যার বিবেচনায় সবচেয়ে বড় ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি হল ভি-শিপ, তারা পরিচালনা করে প্রায় ৯৫০ টি জাহাজ। আর অবকাঠামোগত ভাবে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনকে বলা চলে সবচেয়ে বড় শিপ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। বিশ্বের বড় চারটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি যারা সম্মিলিত ভাবে হয়ত ৩০০০ জাহাজ ব্যবস্থাপনা করে, তাদের সবার অফিস সম্মিলিত ভাবে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন অফিস থেকে ছোট হবে। কিন্তু বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজের সংখ্যা মাত্র ৯ টি।
যে কোনো শিপ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি তাদের ফ্লিট অনুযায়ী তাদের কর্মকর্তা এবং পরিচালক নিয়োগ করে। যেমন যে কোম্পানি শুধু কন্টেইনার শিপ চালায়, তাদের অফিসে রাখা হয় কন্টেইনার শিপে অভিজ্ঞ ক্যাপটেন ও চীফ ইঞ্জিনিয়ার। যে কোম্পানি শুধু ট্যাংকার পরিচালনা করে, তারা ট্যাংকারে অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ করে। আবার কিছু কোম্পানি শুধু সুপার ট্যাংকার চালায়, তারা সুপার ট্যাংকারে অভিজ্ঞ লোকজন নিয়োগ করে, কারন ১০-২০ হাজার টন জাহাজ পরিচালনায় অভিজ্ঞ কারও পক্ষে ২-৩ লাখ টনের জাহাজ ব্যবস্থাপনা সম্ভব না।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন পরিচালনায় যাদের নিযুক্ত করা হয়, তারা সর্বোচ্চ ৩০০০ টন জাহাজ চালনায় অভিজ্ঞ, এবং বন্দর, কার্গো, ট্র্যানস ওশানিক ন্যাভিগেশন সমন্ধে তাদের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের নাবিকরা ২-৩ লাখ টন ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন সুপার ট্যাংকার চালায়, গ্যাস ট্যাংকার চালায়, মেগা কনটেইনার শিপ চালায়। এসব নাবিকদের পেশাগত যোগ্যতার সনদ বা সার্টিফিকেট অফ কমপিটেন্সি ইস্যু করে সমূদ্র পরিবহন অধিদপ্তর। এবং এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সর্বোচ্চ পদে সাধারনত যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তাদের ৩০০০ টনের বেশী ধারন ক্ষমতার জাহাজ পরিচালনায় তাদের অভিজ্ঞতা নেই। বাংলাদেশের প্রাক্তন নাবিকরা বিদেশের বড় এবং স্বনামধন্য কোম্পানিতে সুনামের সঙ্গে চাকরি করে। যুক্তরাজ্যের এমসিএ হলো বিশ্বের নৌপরিবহন নীতিমালা সৃষ্টির সূতিকাগার, তাদের ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট অফ কমপিটেন্সি বিশ্বে সবচেয়ে মর্যাদা সম্পন্ন। কালো চামড়া হয়েও সাদাদের এমসিএ তে চীফ এক্সামিনার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ন পদে বাংলাদেশের সাবেক নাবিকরা সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সমূদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কিংবা পায়রা বন্দর, শিপিং কর্পোরেশন পরিচালনার জন্য কখনোই বাংলাদেশের নাবিকদের বিবেচনা করা হয় না। যারা যুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষিত, তাদের অফিসে বসিয়ে হাদিসুর রহমানের মত নিরিহ বেসামরিক লোকদের পাঠানো হয় ইউক্রেইনের যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
দুর্ঘটনা মানে সাধারন কোন ঘটনা নয়, অনিয়মিত ঘটনা দেখেই তাকে দুর্ঘটনা বলা হয়। দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু হলে তাকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। কিন্তু দুর্ঘটনার তদন্ত বা রুটকজ এনালাইসিস করা হয় যাতে ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়। একটি দুর্ঘটনা একটি দীর্ঘ চেইন অব ইভেন্টস বা ঘটনা পরিক্রমার শেষ অংশ।
দুর্ঘটনা রোধের প্রথম এবং সর্বোত্তম উপায় হলো, দুর্ঘটনা ঘটার মত পরিস্থিতি না হতে দেয়া। যেমন একজন নৌ-ভ্রমনে বের হয়ে নৌকাডুবীতে মারা গেল। যদি সে নৌকা ভ্রমনে না যেত, দুর্ঘটনা ঘটতোই না। এর পর যদি যেতেই হয়, নৌকাটি পরীক্ষা করে নেয়া উচিত ছিল, ঝুকিপূর্ণ নৌযানে যাওয়া উচিত না। অতপর যদি যেতেই হয়, তার লাইফ জ্যাকেট পরা উচিত ছিল।
বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের দুর্ঘটনা রোধ করা যেত প্রথমেই, তা হলো ১৫ ফেব্রুয়ারীতে ঘোষিত ঝুকিপূর্ন ইউক্রেইন পোর্টে যাওয়া থেকে বিরত থাকা। এর পরও নোঙর করার পরদিন যখন বাস্তবিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, তারপরেও সাত দিন যাবৎ একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে নোঙর করে বসে না থাকলে এটা ঘটত না। আগুনে হাত পুড়ে গেলে দোষ আগুনের কিংবা হাতের নয়, যে হাতটা আগুনে ঢুকিয়েছে তার। অক্ষত বাকি নাবিকদের দ্রুত নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া একটি প্রশংসনীয় কাজ, কিন্তু কখনোই তা হাদিসুর রহমানের জীবনের চেয়ে বড় নয়। হাদিসুর রহমানের মৃত্যুর কারণ কোন মিসাইল বা অগ্নিকাণ্ড নয়। তার মৃত্যুর কারন অনেকের দায়িত্বে অবহেলা। এ রকম দুর্ঘটনার পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো তা বের করার জন্য শার্লক হোমসের প্রয়োজন নেই। বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের গত দু সপ্তাহের ই-মেইল কমিউনিকেশন বিশ্লেষণ করলেই পাওয়া যাবে কে কতটুকু দায়ী।
সব শেষে একটা কথা বলতে চাই, দেশের উন্নয়ন প্রয়োজন, সমৃদ্ধি প্রয়োজন, কিন্তু হাদিসুর রহমানের মত কোনো তরুণের জীবন উৎসর্গ করে ‘বাংলার সমৃদ্ধির’ প্রয়োজন নেই।
লেখক: ক্যাপ্টেন মাহমুদ
আমেরিকান ঈগল ট্যাংকারস