search the site
দেশি কোম্পানির জাহাজগুলোতে ক্যাডেট/জুনিয়র অফিসারদের বেতন
দেশি কোম্পানির জাহাজগুলোতে ক্যাডেট/জুনিয়র অফিসারদের বেতন
আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৭/ই) 17 September 2021
প্রায় প্রতিটি পেশাতেই একটা নূন্যতম বেতন স্কেল নির্দিষ্ট করা আছে। এমনকি লোকাল বাসেও দেখা যায় ‘সর্বনিম্ন ভাড়া ৫/১০ টাকা’ লেখা! রিকশায় করে ১ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে গেলেও ১০ টাকার নিচে দেয়া যায়না। অন্যভাবে বলা যায়, রিকশার সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা, সেটা ১০ সেকেন্ডের জন্য হলেও। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সবার জানা ‘রয়েল প্রফেশন’ মেরিন ইঞ্জিনিয়ার/অফিসারদের কোন নির্দিষ্ট সর্বনিম্ন বেতন নেই! মাছের বাজারের মতো দরাদরি করে, হার-জিতের লড়াই শেষে একটা সুরাহা করতে হয় সাইন অনের আগে।
ব্যবসায় শিক্ষার মূলনীতি থেকে আমরা জানি ‘যোগান বাড়লে চাহিদা কমে আর যোগান কমলে চাহিদা বাড়ে’! দুর্ভাগ্যক্রমে (উপদেষ্টাদের সুদূরপ্রসারী চিন্তার অভাবে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কিছু অর্জনের লক্ষ্যে) গত ৭/৮ বছরে মেরিন ক্যাডেটদের যোগান চাহিদারও প্রায় কয়েকগুণ বেশি। ফলে মার্কেটে ক্যাডেটদের চাহিদা কমে গেছে, ফলশ্রুতিতে মূল্যায়নও। ২০১৩ সালে যেখানে আমি ২০০ ডলার পেয়েছি ক্যাডেট হিসেবে, এর কয়েকবছর পরেই তা ১০০/৫০ এমনকি শুন্য’তে নেমে আসার রেকর্ডও আছে। স্কুল-কলেজে সেরা ফলাফল করে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে একটা ছেলে/মেয়ে মেরিন ক্যাডেট হিসেবে চান্স পায়। এরপর কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় ২ বছর ট্রেনিং শেষে তারা সমুদ্রে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। অথচ এমন কোয়ালিফাইড একজনের মাসের পর মাস গাধার মতো খাটুনির মূল্য মাত্র বেঁচে থাকার খাবারটুকু! এই একুশ শতকে এসেও এমন ‘মডার্ন স্লেভারি’ মেনে নেয়া যায়?
এই ১০০/৫০ ডলার বা বিনামূল্যে পরিশ্রম করা ক্যাডেটদের নির্দিষ্ট সময়ের সী-সার্ভিস শেষে অফিসার হবার জন্য পরীক্ষা দিতে হয়। বিভিন্ন কোর্স, পড়াশোনা, রিটেন, ভাইবা শেষ করে অফিসার হবার সার্টিফিকেট পেতে বছরখানেক সময় লাগে যে সময়টাতে তাদের আয়ের কোন উপায় থাকেনা। কোর্স, পরীক্ষার ফি, একবছর থাকা-খাওয়ার খরচ ধরে নূন্যতম আড়াই থেকে তিনলাখ টাকার একটা ধাক্কা সমস্ত সী-টাইম শেষ করা ক্যাডেটদের সামলাতে হয়। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, ৯৫% ক্যাডেট তাদের ক্যাডেটশিপে পাওয়া টাকা দিয়ে (অনেকে আবার ‘কাবিখা’ প্রকল্পের জন্য একাউন্ট ব্যালেন্স জিরো) ক্লাস-থ্রি পরীক্ষা কমপ্লিট করতে পারেনা। সেই ভাগ্যবান ৫% বাদে প্রত্যেক ক্যাডেটকে ক্লাস-থ্রি সিওসি পরীক্ষা দেয়ার সময় ঋণের বোঝায় জর্জরিত হতে হয়। হাস্যকর ব্যাপার হলো, এরা ঋণ করে যাদের থেকে তারা আবার আরেক কপাল-পোড়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঋণদাতা হন জাহাজের জুনিয়র অফিসাররা (থার্ড/ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার বা থার্ড/সেকেন্ড অফিসার)! ভাবছেন তারা তো অফিসার মানুষ তাদের কেন কপাল-পোড়া বলছি? বলছি, কেননা বর্তমানে বেশিরভাগ দেশি কোম্পানির জাহাজে তাদের র্যাংকের বেতন অনেক ক্ষেত্রে রেটিংদের চেয়েও কম! যেহেতু ক্যাডেটদের যোগান বেশি তাই জুনিয়র অফিসার র্যাংকেও যোগান বেড়ে গেছে। ফলে জুনিয়র অফিসারদের মূল্য কমে এখন রেটিংদেরও নীচে। যোগান-চাহিদার সুযোগটা ধূর্ত ব্যবসায়ীরা খুব ভালভাবেই নিচ্ছে। এরা ২০১৩/১৪ এর পর একধাক্কায় জুনিয়র অফিসার র্যাংকের বেতন তিন ডিজিটে নিয়ে এসেছে।
বর্তমান অবস্থা এমন যে, অনেক ক্যাডেট, জুনিয়র অফিসাররা আফসোস করে কেন এত পড়াশোনা করে, ২/৩ বছর সময় নষ্ট (?!) করে ক্যাডেট হলো! মাত্র ৬ মাসের ট্রেনিং নিয়ে রেটিং কেন নয়? কেননা জাহাজে জয়েন করে তারা দেখে ৬ মাস ট্রেনিং করা একটা ছেলে ১ম কন্ট্রাক্টটে ওএস/ফায়ারম্যান হিসেবে ৪০০ ডলারের বেশি বেতন পায় অথচ ক্যাডেটদের বেতন ১৫০-২৫০ ডলার। ফ্রেশ কিংবা এক্সপেরিয়েন্সড থার্ড অফিসার/ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ারদের বেতন এবি, অয়েলার থেকেও কম।
ছোট্ট এ জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এদেশে জোর গলায় আন্দোলন না করলে, রাস্তায় না নামলে কোন যৌক্তিক দাবীও পূরণ হয়না। কিন্তু আমরা যেহেতু ‘ভাসমান’ একটা ছোট্ট কমিউনিটি+আমরা শান্তিপ্রিয় ‘রয়েল মেরিনার’ তাই এসব রাস্তায় নেমে আন্দোলন করা আমাদের দ্বারা হবেনা। আবার অন্যান্য কমিউনিটির মতো একতাও আমাদের মধ্যে নেই যে আমরা কর্মবিরতিতে যাবো দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত। একজন ডাক্তার বা বাস ড্রাইভারকে কেউ অন্যায়ভাবে কিছু করলে দিনে দিনে সমস্ত ডাক্তার বা ড্রাইভারদের সংগঠন কর্মবিরতিতে যায় বিষয়টি সুরাহা না করা পর্যন্ত। অথচ আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। কেউ একজন কম বেতনে যাবেনা বললে আরেকজন লুফে নিবে সে প্রস্তাব! এমনকি ২০/৫০ হাজার টাকা দিতেও অনেকে কার্পণ্য করবেনা। আর এ ব্যাপারগুলো আমাদের বর্তমানে অসহায় পেয়ে যারা ঠকাচ্ছেন তারা ভালভাবেই জানেন। আর জানেন বলেই শেষ কয়েকদিন ব্যবহার করা টুথপেষ্টের মতো নিংড়ে ব্যবহার করছেন আমাদের জুনিয়রদেরকে।
আমাদের মেরিন অফিসারদের যে কোন সংগঠন নেই এমনটা না। ‘বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার এসোসিয়েশন (BMMOA)’ নামে আমাদের কার্যকরী একটা প্ল্যাটফর্ম আছে যারা আমাদের সমস্যা, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে অবিরাম কাজ করছে। দুঃখজনকভাবে, BMMOA থেকে গত নির্বাচনী ইশতেহারে জুনিয়রদের সর্বনিম্ন বেতন স্কেল নিয়ে কাজ করার কথা উল্লেখ থাকলেও এটি নিয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি চোখে পড়েনি। গত ৪/৫ বছরে BMMOA মেরিনারদের জন্য নিঃসন্দেহে অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছে কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো তেমন কিছুই করতে পারেনি। তাই আমি দেশীয় জাহাজ কোম্পানিতে রাত-দিন কঠোর পরিশ্রম করা ক্যাডেট/জুনিয়র অফিসারদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের জন্য সম্মানজনক একটা সর্বনিম্ন বেতন স্কেল নির্দিষ্ট করার জন্য BMMOA কে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।
মেইলে দেশী কোম্পানিগুলোর বাল্ক ক্যারিয়ারে ক্যাডেট এবং অপারেশন লেভেলের অফিসার/ইঞ্জিনিয়ারদের ‘সর্বনিম্ন’ বেতন কাঠামোর একটা ‘প্রস্তাবিত’ ছবি এটাচড করে দিলাম। আশা করি, বেশিরভাগ ক্যাডেট/জুনিয়র অফিসার এ স্কেলের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবে। BMMOA এটাকে ‘নূন্যতম ধরে’ জরুরি ভিত্তিতে এ ব্যাপারে দ্রুত এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমার আস্থা-দৃঢ়বিশ্বাস।
এ ব্যাপারটা নিয়ে আমরা জুনিয়ররা লেখালেখি করে বা অনলাইনে গলা ফাটিয়ে বিশেষ কিছু করতে পারবো বলে মনে হয়না। আর এই লেখাটি কোন অভিযোগপত্রও নয়। শুধুমাত্র মেরিন অফিসারদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন আর শ্রদ্ধেয় সিনিয়রদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বর্তমানে দেশী কোম্পানির জাহাজগুলোতে চাকরি করা ক্যাডেট/জুনিয়র অফিসারদের দুরাবস্থা তুলে ধরেছি যার একটা সুন্দর সমাধানই আমাদের একান্ত কাম্য। আমরা জুনিয়ররা আপনাদের সন্তান বা ভাইয়ের মতো, যারা আপনাদের দ্বারস্থ হয়ে কখনো হতাশ হয়নি, বরং প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি পেয়েছে। আশা করবো এবারেও আপনারা সবাই এ ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবেন। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোক…
অনুরোধে,
আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৭/ই)
মেম্বার BMMOA, মেম্বারশিপ নাম্বার-১২১৫৪