search the site
মেরিটাইম সেক্টর বাঁচান
আশরাফ ইবনে-নূর
বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার কারণে সমুদ্রগামী জাহাজের একটি অংশ কার্গো না পাওয়ার ফলে তাদের বন্দরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। বহু পুরনো জাহাজ ভেঙে ফেলা হয়েছে, জাহাজের ভাড়া ৬০-৭০ ভাগ কমে গেছে। ব্যতিক্রম কেবল কনটেইনার ও তেলবাহী জাহাজ। তিন বছর আগে ভিয়েতনাম থেকে চিটাগং সিমেন্ট ক্লিংকার পর্যন্ত যে ভাড়া ছিল এখন তা অর্ধেকেরও কম। বাল্টিক ফ্রেইট এক্সচেঞ্জের পূর্বাভাস, ভাড়ার এ হার দুই-তিন বছর স্থায়ী হতে পারে। একই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে জাহাজ ৭০ থেকে ২৮-এ দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশে জাহাজ বৃদ্ধি সময়সাপেক্ষ; নাবিকদের চাকরির বাজারও সংকুচিত। দেশীয় ও বিদেশি জাহাজ পরিচালনার জন্য যে অফিসার বা ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন হয় তা পূরণে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি এবং স্বীকৃতি পায় ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির ১৪ শাখার একটি হিসেবে। বাংলাদেশি মেরিনাররা বিভিন্ন দেশে সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন মেরিটাইম প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে নিয়োজিত আছেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর সুচিন্তিত দূরদর্শিতায় মৎস্য সম্পদ আহরণে প্রতিষ্ঠিত হয় সম্পূর্ণ আলাদা প্রতিষ্ঠান মেরিন ফিশারিজ একাডেমি। এর ক্যাডেটরা শুধু মৎস্য আহরণ ট্রলারে চাকরির জন্যই যোগ্য এবং তাদের কর্মপরিধি মৎস্য আহরণ সেক্টরেই সীমাবদ্ধ। এ একাডেমিকে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা হয়। মৎস্য খাতে জনশক্তির চাহিদা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। কিন্তু ধস নামে মার্চেন্ট মেরিন সেক্টরে। বেকার হয়ে পড়েন শত শত নাবিক। এর কারণ ভিসা জটিলতা, দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ ২৮-এ নেমে আসা, ১৮টি প্রাইভেট মেরিন একাডেমির অনুমোদন, সরকারি-বেসরকারি একাডেমির ক্যাডেট সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাইভেট একাডেমি ও জাল সনদপ্রাপ্ত অযোগ্য নাবিক রফতানিতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর নিয়োগ বন্ধ- সর্বোপরি অসাধু ব্যবসায়ী ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী অপচেষ্টা। বাধ্য হয়েই বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি ক্যাডেট সংখ্যা ৩০০ থেকে কমিয়ে মাত্র ৮০ জনে নামিয়ে এনেছে। আর বেসরকারি ১৮টি একাডেমির ১৫টি ক্যাডেটশূন্য অবস্থায় বন্ধের দোরগোড়ায়। এমন নাজুক অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে যখন মেরিটাইম সেক্টর ব্যস্ত, ঠিক তখনই স্বার্থান্বেষী একটি মহল তৎপর হয়ে ওঠে ফিশারিজ ক্যাডেটদের সিডিসি (ধারাবাহিক ডিসচার্জ সনদ) প্রদানের মাধ্যমে মাছ ধরা জাহাজ থেকে সরাসরি বাণিজ্যিক জাহাজে চাকরি প্রদানের দাবিতে। মেরিন একাডেমি থেকে STCW-২০১০ অনুযায়ী প্রশিক্ষিত ক্যাডেটরা একমাত্র সিডিসি অর্জন করে বাণিজ্যিক জাহাজের চাকরির জন্য যোগ্য। আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হওয়ায় ফিশারিজ ক্যাডেটদের বাণিজ্যিক জাহাজে নিয়োগ দিলে আইএমওর সাদা তালিকা থেকে বাদ পড়বে বাংলাদেশ। এর প্রভাবে সমুদ্র পরিবহন সেক্টর ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিপন্ন হবে। ২০০৮ সালে European Maritime Safety Agencyর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে বলে যায়, ‘আমাদের অথরিটি যেভাবে ফিশারিজ ক্যাডেটদের সিডিসি দিতে যাচ্ছে, সেটা STCW-র প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ সরেজমিন তদন্তে দেখা যায়, ফিশিং জাহাজে সনদধারী কর্মকর্তার অভাব এতই প্রকট যে, বর্তমানে ২৩৬টি ফিশিং জাহাজের জন্য মাত্র ৯৩ জন ফিশিং সনদধারী স্কিপার ও ১১২ জন ফিশিং সনদধারী ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন। অতএব, মেরিন ফিশারিজ একাডেমির ক্যাডেটদের সিডিসি প্রদানের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে ফিশিং জাহাজে চাকরি নিরুৎসাহিত করলে যোগ্যতাধারী অফিসারের সংকট প্রকটতর হবে। মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আহসান ইকবাল চৌধুরী সম্প্র্রতি বলেন, ফিশিং জাহাজে ইতিমধ্যে ৩০-৪০% অফিসারের কমতি আছে। তার ওপর গভীর সমুদ্রে টুনাসহ অন্যান্য মৎস্য আহরণে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তার জন্য ফিশিং জাহাজ চালনার লোকবলের অনেক অভাব। সমুদ্র বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশাল জলখণ্ড বাংলাদেশের সীমানাভুক্ত হয়েছে। বিশাল এ এলাকায় মৎস্য সম্পদ আহরণের সম্ভাবনা বিপুল। মেরিন ফিশারিজ থেকে পাস করা ক্যাডেটরা এ খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে সরকারি মেরিন একাডেমির ক্যাডেট সংখ্যা ৮০-তে নামিয়ে এনেছে এবং বেসরকারি একাডেমিগুলোও ক্যাডেটশূন্য হয়ে পড়েছে, সেখানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে ফিশারিজ সেক্টর থেকে ক্যাডেটদের বাণিজ্যিক জাহাজে যোগদান করানো অযৌক্তিক। গত ৮ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর জাকিউর রহমান ভুঁইয়া বলেন, ফিশারিজ একাডেমির ক্যাডেটদের সিডিসি প্রদানের কোনো যুক্তি নেই বলে আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। রেমিট্যান্সের ১৪% আসে মেরিন সেক্টর থেকে। চাকরিহীন, অধিক সমস্যায় জর্জরিত মেরিন সেক্টরে ফিশারিজ ক্যাডেটদের অনুপ্রবেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে একদিকে যেমন মৎস্য সেক্টর দক্ষ লোকবলের অভাবে ধ্বংস হবে, অন্যদিকে মেরিন সেক্টরের মৃত্যু নিশ্চিত করতে কফিনের শেষ পেরেকটিও ঠুকে দেওয়া হবে। জনগণের অর্থে পরিচালিত মেরিন ফিশারিজ একাডেমির ক্যাডেটরা নিজস্ব সেক্টরে অবদান রেখে ফিশিং ফ্লিটে দক্ষ জনবল তৈরির পাশাপাশি শক্তিশালী ফিশিং ফ্লিট গড়ে তুলবে_ এটাই কাম্য। সসমুদ্রগামী জাহাজের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও সাবেক সহসভাপতি ঢাকা শিল্প বণিক সমিতি
Source: Samokal