গ্লোবাল মেরিটাইম প্রকল্প এক যুগ ফাইলবন্দী উপকূলে ঝুঁকি নিয়ে চলছে নৌ-যান

Comments Off on গ্লোবাল মেরিটাইম প্রকল্প এক যুগ ফাইলবন্দী উপকূলে ঝুঁকি নিয়ে চলছে নৌ-যান

1427484324

সমুদ্র উপকূলে নৌ-যান চলাচলে নিরাপত্তা নেই। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো সুবিধা না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই চলছে নৌ-যানগুলো। নৌ-চলাচল ও নিরাপত্তার জন্য গ্লোবাল মেরিটাইম ডিসট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম (জিএমডিএসএস) আন্তর্জাতিক মানের করার লক্ষ্যে প্রায় একযুগ আগে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলেও তা পরিকল্পনা কমিশন ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মধ্যে ফাইল চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাই সেই পুরনো সনাতনি পদ্ধতির ভেসেল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আর মান্ধাতার আমলের সতর্কীকরণ পদ্ধতির উপর নির্ভর করেই সমুদ্র উপকূলে এখনো নৌ-যান চলাচল করছে। পুরনো এসব সতর্কীকরণ যন্ত্রপাতির অধিকাংশ বিকল। মনিটরিং ব্যবস্থাও দুর্বল বলে জানিয়েছেন নৌ-যান মালিক ও চালকরা। এ নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণভাবে নৌ-চলাচল করছে। এ কারণে নৌ দুর্ঘটনা বেড়েছে। কোন প্রকার নিরাপত্তা ছাড়াই নৌ-যানগুলো উপকূলীয় সমুদ্র থেকে গভীর সমুদ্রে চলাচল করছে। অথচ নদীমাতৃক দেশ হিসাবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি এবং সেফটি অব লাইফ অ্যাট সি কনভেনশনে সই করলেও বিধি অনুযায়ী অবকাঠামোগত উন্নয়নের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা পূরণ করা হয়নি। দুর্ঘটনার আশংকায় নৌ-পরিবহন সেক্টরের সাথে যুক্ত দপ্তরগুলো চিঠি চালাচালি করে নিজেদের দায়িত্ব পালন বা দায় এড়ানোর কাজটি দীর্ঘদিনের রেওয়াজ হিসাবেই যেন অব্যাহত রেখেছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর থেকে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত যে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে তাতে দেশের সমুদ্র উপকূলে নৌ-যান চলাচল যথেষ্ট নিরাপদ নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ উপকূল ভাগের কুয়াকাটা, নিঝুম দ্বীপ, ঢালচর ও দুবলার চরসহ বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে যেসব দ্বীপ বা উপ-দ্বীপ রয়েছে তার কোথাও কোন লাইট হাউসই (বাতিঘর) নেই। সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া ও কক্সবাজারে লাইট হাউস থাকলেও তা অনেক পুরনো। সিংহভাগ যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে গেছে। মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ না পাওয়ায় লাইট হাউজগুলো কার্যকর করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) পরিচালিত মংলা ও ছিলিমপুর রেডিও স্টেশনেরও বেহাল দশা। এ দুটি স্টেশনের যন্ত্রপাতি ও জনবল কোনটাই নেই। শুধু নামেই এখন এ স্টেশন দুটি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে। স্থলভিত্তিক প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা পর্যন্ত নেই। অথচ সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায়ও নৌ-যান চলাচলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে সমুদ্র তীরবর্তী ৭টি স্থানে পৃথক নৌ নিরাপত্তার জন্য অবকাঠামো, নিরাপত্তা প্রহরা ও টহল ব্যবস্থা স্থাপন করার কথা ছিল। ঐ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক মান অর্জনের টার্গেট নিয়ে। একই সঙ্গে নেভিগেশনাল সহায়তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন ও পরিচালনা করার লক্ষ্য ছিল নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের।
সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রুটের জাহাজগুলো মনিটরিং করার মতো যথেষ্ট অবকাঠামো ও জনবল সুবিধা নেই। তাই সমুদ্রে চলাচল করার সময় জাহাজগুলোর সাথে কোন যোগাযোগ থাকে না। মনিটরিং ছাড়াই নিজ দায়িত্বে একাকি চলাচলকারী জাহাজগুলো জলদস্যুদের কবলে পড়লে কিংবা যান্ত্রিক ত্রুটিসহ যে কোন দুঘর্টনার শিকার হলে তার খবর পাওয়া যায় না। দুর্ঘটনা কবলিত হলে উদ্ধার করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কনভেনশনে সই করার পর শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মান রক্ষায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালে আধুনিকায়নের প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়। পরের বছর জিএমডিএসএস এবং ইনটিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। ব্যয়ের খাতগুলোর বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে পরিকল্পনা কমিশন তা ফেরত পাঠায়। তবে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন বার বার ফাইল চালাচালি করলেও বর্তমানে প্রকল্পটি অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশের অভ্যন্তরে সমুদ্র তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে নৌ-নিরাপত্তা, নিরাপত্তা প্রহরা ও টহল ব্যবস্থা উন্নয়ন, নেভিগেশনাল সুবিধা ও ২৪ ঘণ্টা জাহাজগুলোর সাথে বন্দরের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সার্বক্ষণিক গভীর সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের খবরা-খবর বন্দরে বসেই পাওয়া যাবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৮৮ কোটি ও এক্সিম ব্যাংক অব কোরিয়া বাকি ২৮২ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেবে। এ ঋণের বিপরীতে সুদের হার দশমিক ১ শতাংশ। প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার ও কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে এক বছর আগেই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।

প্রকল্পের আওতায় জিএমডিএসএসসহ বেতার যোগাযোগের জন্য সমুদ্র উপকূলীয় স্থাপনা, ভেসেল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, জাহাজের তথ্য প্রদান পদ্ধতি (শিপ রিপোর্টিং সিস্টেম), নৌ চালনায় সহায়তা (এইডস টু নেভিগেশন), জাহাজের নিরাপত্তা সতর্কীকরণ পদ্ধতি, দূরবর্তী জাহাজ চিহ্নিতকরণ ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ বিষয়ে লং রেঞ্জ আইডেনটিফিকেশন অ্যান্ড ট্র্যাকিং অব শিপস কার্যক্রম আধুনিকায়ন করার কথা রয়েছে। এজন্য কোরিয়ার এএনএসই টেকনোলজি সম্ভাব্যতা যাচাই করতে একটি সমীক্ষার কাজও গত বছর সম্পন্ন করেছে।

Source: Ittefaq

Comments are closed.